ডা. মো. তারেক ইমতিয়াজ (জয়)
ক্রিয়েটিনিন কী?
ক্রিয়েটিনিন আমাদের শরীরে মাংশপেশী থেকে বিভিন্ন বিপাক ক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হওয়া একটি উপাদান। এই ক্রিয়েটিনিন এর বড় একটি অংশ কিডনির মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায় এবং কিছু অংশ রক্তে থেকে যায়, যার মাত্রা প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে পুরুষের ক্ষেত্রে ০.৭ মিলিগ্রাম থেকে ১.৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত এবং নারীর ক্ষেত্রে ০.৬ মিলিগ্রাম থেকে ১.২ মিলিগ্রাম পর্যন্ত, যা রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা হিসেবে বিবেচিত।
কিডনি রোগ নির্ণয়ে ক্রিয়েটিনিনের ভূমিকা কী?
একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে সাধারণত ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা সবসময় বজায় থাকে। কোনো কারণে যদি কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কিডনির কার্যকারিতা কমে যায় তখন শরীরে তৈরি হওয়া এই ক্রিয়েটিনিন ঠিক মতো কিডনি থেকে আর বের হতে পারে না। তখন রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই কারও কিডনির কার্যকারিতা ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য ‘সেরাম ক্রিয়েটিনিন’ (Serum creatinine) পরীক্ষাটি করা হয়। তবে এই সেরাম ক্রিয়েটিনিন কিডনির কার্যকারিতা দেখার একটি প্রাথমিক পরীক্ষা। এটা ছাড়াও অন্যান্য কিছু আরও কিছু পরীক্ষা আছে যেমন: প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন যাচ্ছে কিনা তা দেখা যা প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষায় বোঝা যায়; কিডনির আল্ট্রা-সনোগ্রাফি; জিএফআর নির্ণয় ইত্যাদি।
তবে অন্যান্য কিছু কারণেও সাময়িকভাবে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে। যেমন: কেউ যদি সম্প্রতি প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি খায়, কারও যদি ডায়রিয়া বা বমি হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সাময়িকভাবে ক্রিয়েটিনিন বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই ক্রিয়েটিনিনের সেই মাত্রা আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।
ক্রিয়েটিনিন বৃদ্ধির কারণ কী?
কিডনির কার্যকারিতা যেসব কারণে কমে যায় সেসব কারণেই ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যায়। যেমন:
– দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস
– দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ
– ক্রনিক গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস (Chronic glomerulonephritis) বা দীর্ঘমেয়াদী কিডনির প্রদাহ
– কিডনিতে সিস্ট সংক্রান্ত কোনো রোগ যেমন: পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ
– মূত্রতন্ত্রের জন্মগত কোনো রোগ যেমন: পোস্টেরিয়র উরেথ্রাল ভাল্ভ (Posterior urethral valve)
– সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথিম্যাটোসাস (Systemic lupus erythematosus)
– দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যথানাশক কোনো ঔষধ সেবন
ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমানোর উপায় কী?
যেসব কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়েছে চিকিৎসার মাধ্যমে সেই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমে আসবে। সরাসরি ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমানোর কোনো ঔষধ নেই। যেমন: কারও যদি দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা হিসেবে কিডনি আক্রান্ত হয় (ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি), সেক্ষেত্রে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেড়ে যেতে বাড়ে। এক্ষেত্রে সময়মতো ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমে আসবে। আবার কারও যদি দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকে, সেক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনলে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কমে আসবে। তবে সময়মতো যদি চিকিৎসা করা না হয় তাহলে কিডনি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। কিডনি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে এই ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা আর আগের মতো স্বাভাবিক মাত্রায় আসেনা । বরং, তা সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং একটা সময় পরে রোগীর ডায়ালাইসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট এর প্রয়োজন হতে পারে।
অনেক সময় প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগের তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না। তাই যাদের কিডনি রোগ হবার ঝুঁকি আছে অর্থাৎ, যারা দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে তাদের উচিৎ হবে বছরে অন্তত একবার সেরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষাটি করা।
[লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য); সহকারী রেজিস্ট্রার, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।]