যশোর সংবাদদাতা: যশোরের মণিরামপুর উপজেলার তাহেরপুর গ্রামের খলিলুর রহমান। বাজারে চাহিদাসম্পন্ন ফসল বা নতুন জাত ও নতুন ফসল উৎপাদনের জন্য তাঁর বেশ পরিচিতি। তবে এখন তাঁকে অনেকেই ‘তরমুজ খলিল’ নামে চেনে। চুয়াডাঙ্গায় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে তরমুজের চাষ দেখে অনুপ্রাণিত হন খলিল।
সেই অনুপ্রেরণা নিয়ে ওই এলাকা থেকে বীজ সংগ্রহ করে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে নিজ জমিতে চাষ শুরু করেন।
সেই তরমুজ চাষ করে এলাকায় বেশ সাড়া ফেলেছেন খলিল। ব্যতিক্রমী সোনালি বর্ণের বিদেশি গোল্ডেন ক্রাউন, ব্ল্যাক বেবি ও বাংলালিংক তরমুজ চাষ করেছেন তিনি।
খলিলের মতো দেশের বিভিন্ন এলাকার চাষি এখন মূল মৌসুমের বাইরে এই তরমুজ চাষ করছেন। তাই দাম পাচ্ছেন ভালো, চাষও বাড়ছে দিন দিন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে তরমুজের উত্পাদন কমছে। এই সময়ে নতুন জাতের এসব তরমুজ এই ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে।
সম্প্রতি সরেজমিনে খলিলের তরমুজের ক্ষেতে দেখা যায়, সবুজ গাছের বোঁটায় বোঁটায় ঝুলছে রং-বেরঙের তরমুজ। বাঁশ আর প্লাস্টিকের জালের সুতায় তৈরি মাচায় ধীরে ধীরে আকারে বড় হচ্ছে তরমুজ। ফলন ভালো হওয়ায় খলিলের চোখ-মুখে আনন্দের ঝিলিক।
খলিল বলেন, পাঁচ বিঘা জমিতে তরমুজের বীজ বপন করেন। বীজ বপনের পর গাছ লম্বা হলে মাচা দিতে হয়। বীজ বপনের ২৫ থেকে ৩০ দিন পর ফুল আসে। আর দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে তরমুজ বিক্রি শুরু করা যায়। তিনি বলেন, আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূলে থাকলে অন্তত চার লাখ টাকা লাভ হবে।
মণিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিসার আবুল হাসান বলেন, খলিল একজন আদর্শ চাষি। তিনি চাষি ও বেকার যুবকদের জন্য উদাহরণ। কৃষি বিভাগ চাষি খলিলকে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
গত কয়েক বছর ধরেই চুয়াডাঙ্গায় অসময়ে ব্ল্যাক বেবি ও গোল্ডেন ক্রাউন জাতের তরমুজের আবাদ বাড়ছে। প্রতি বিঘায় ৭০ থেকে ৮৫ মণ তরমুজ পাওয়া যাচ্ছে। ব্ল্যাক বেবি জাতের তরমুজ প্রতি মণ এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় এবং গোল্ডেন ক্রাউন জাতের তরমুজ এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তরমুজের আবাদ করে এই এলাকার কৃষকের অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে। সাধারণত বীজ বপনের দুই মাসের মাথায় ফল পাওয়া যায়। গোল্ডেন ক্রাউন তরমুজের জাতে বেশি লাভবান হচ্ছে। বিঘাপ্রতি চাষে খরচ হয় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। সব ধরনের খরচ বাদ দিয়ে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা মুনাফা থাকে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ তালহা জুবাইর মাসরুর বলেন, এ অঞ্চলে গত এক দশক ধরেই ব্ল্যাক বেবি ও গোল্ডেন ক্রাউন জাতের তরমুজ চাষে আগ্রহ বাড়ছে। তরমুজের মূল মৌসুমের বাইরে এসব তরমুজ চাষ হয়। এর ফলন ভালো, চাষও লাভজনক। এ ছাড়া এখানকার তরমুজ এখন সারা দেশেই যাচ্ছে।
ভোলায়ও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে গ্রীষ্মকালীন বেবি তরমুজ চাষ। কম খরচে অধিক লাভবান হওয়ায় কৃষকরাও এ ফলটি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। গ্রীষ্মকালে পরিত্যক্ত জমিতে বেবি তরমুজের চাষাবাদ করে এরই মধ্যে অনেক কৃষক সফল হয়েছে। তাদের দেখাদেখি অন্য কৃষকরাও এ তরমুজ চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। মৌসুমি তরমুজের মতো বেশি ফলন না হলেও হেক্টরপ্রতি ৪০ টন তরমুজ উত্পাদন হচ্ছে।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের কৃষক মো. রাসেল। তিনি জানালেন, বাড়ির পাশে ২০ শতাংশ জমিতে গত জুলাইয়ে ১২ হাজার টাকা খরচ করে বেবি তরমুজ লাগিয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। আরো ৪০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন। রাসেল বলেন, ‘অল্প খরচে বেশি লাভ হয়, তাই আগামী দিনে আরো বেশি জমিতে এ জাতের তরমুজ চাষ করব। ’
ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর মাটি-পানিতে লবণাক্ততা বাড়ায় ও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দক্ষিণাঞ্চলে ধান উৎপাদন কমতে থাকে। পর পর কয়েক বছর ধান উত্পাদন কমায় কৃষকরা বিকল্প হিসেবে তরমুজ চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ২০১১ সালের পর থেকেই এ অঞ্চলে তরমুজ চাষ বাড়তে থাকে। বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয়েছে পটুয়াখালী, বরগুনা এবং ভোলা জেলায়। তুলনামূলক কম চাষ হয়েছে বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলায়। এ অঞ্চলের উত্পাদিত তরমুজের বাজার দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে গত ছয় বছরের ব্যবধানে তরমুজের উত্পাদন প্রায় ২৮ শতাংশ কমেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ টন। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৩ হাজার ৩৪৭ হেক্টর জমিতে উত্পাদন কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯৮ টন। প্রতি কেজি তরমুজের দাম ১৫ টাকা বিবেচনায় নিলে দেশে পণ্যটির বাজার দাঁড়ায় দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা থাকে প্রতি মিটারে ২ থেকে ১০ ডিএস। ফসল উৎপাদনের জন্য জমিতে সহনীয় মাত্রা ২ ডিএস। এর বেশি লবণাক্ত জমিতে ফসল উত্পাদন করা যায় না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কৃষকের উৎপাদিত এসব তরমুজের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ও বিপণনব্যবস্থাকে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রাকৃতিক বৈরিতা থেকে তরমুজ ক্ষেত রক্ষায় কৃষকদের নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা প্রয়োজন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মেহেদী মাসুদ বলেন, অল্প সময়ে অধিক ফলন হওয়ায় মৌসুমি ফলের মধ্যে তরমুজের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার নদী বিধৌত ভূমি পলি মাটির আস্তরণের কারণে তরমুজ চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বাড়তি তেমন কোনো ঝুঁকি ছাড়াই প্রতিবছর তরমুজ চাষ করছেন কৃষকরা। ভালোভাবে মোড়কজাত করতে পারলে কৃষকের দাম নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি অমৌসুমে ফলের আবাদ বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষকের দাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুষ্টি চাহিদা পূরণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।