সূক্ষ চিন্তনচর্চা শুরু করাটা জরুরি

সূক্ষ চিন্তনচর্চা শুরু করাটা জরুরি

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক: টু বি অর নট টু বি-উইলিয়াম শেকসপিয়ারের বিখ্যাত চরিত্র হ্যামলেটের এই প্রশ্নটির কথা শোনেননি এমন শিক্ষিত মানুষ হয়তো এখন আর পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। হ্যামলেট চরিত্রটির বিখ্যাত হওয়ার যে কয়টি কারণ আছে এর মধ্যে তার প্রশ্ন জর্জরিত ধীরগতির চিন্তাধারা অন্যতম। অন্যদিকে শেকসপিয়ারের আরেক চরিত্র কিংলিয়ার দ্রুত একলাফে কনিষ্ঠ কন্যা কর্ডেলিয়াকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার মতো বড় সিদ্ধান্তনিয়ে ফেলে। তবে শেকসপিয়ারের চিন্তা না করে কাজ করা চরিত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে রোমিও ও জুলিয়েট।

সম্পূর্ণ অপরিণামদর্শী এই চরিত্র দুটি প্রথম দর্শনেই একে অন্যের প্রেমে পড়ে ভয়াবহ পরিণতির শিকার হয়। শেকসপিয়ারের এই চরিত্রগুলো দুই ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। কেউ আছে, যারা হ্যামলেটের মতো বারবার প্রশ্ন করে, আবার কেউ আছে, যারা চিন্তা-ভাবনা ছাড়া হুটহাট কিছু একটা করে বা ভেবে বসে। সাহিত্য সমালোচকরা বলেন, শেকসপিয়ার তাঁর দূরদৃষ্টি দিয়ে পুঁজিবাদ সৃষ্ট একজন অনাগত আধুনিক মানুষের আদলে হ্যামলেট চরিত্রটি চিত্রিত করেছেন। আর লিয়ার, রোমিও বা জুলিয়েট তৈরি হয়েছে সমসাময়িক সামন্ত সমাজের মানুষদের আদলে। সেই সামন্ত সমাজ আর নেই বটে, তবে আমাদের মধ্যে এখনো লিয়ার, রোমিও বা জুলিয়েটদের সংখ্যাই বেশি, হ্যামলেটরা অঙ্গুলিমেয়। অর্থাৎ আমরা এখনো বেশির ভাগ সময় ‘করিয়া ভাবি’, ‘ভাবিয়া করি’ না। বা ভাবলেও তা এত দ্রুত ভাবি যে সেটিকে ভাবনা না বলে বরং সহজাত উপলব্ধি বলাই শ্রেয়।

আমাদের চিন্তার প্রকার নিয়ে গবেষকরা গবেষণা করেছেন। তবে তাঁদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড্যানিয়েল কানেম্যান, যিনি আবার অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন। তাঁর গবেষণা মতে, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ এখনো লিয়ার, রোমিও বা জুলিয়েটের মতো আবেগতাড়িত হয়ে চট করে যেকোনো একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তিনি এই দ্রুত চিন্তন প্রক্রিয়াটির নাম দিয়েছেন ‘সিস্টেম ১’। আবার হ্যামলেটের মতো কিছু মানুষ আছে, যারা ধীরে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে। কানেম্যান এ ধরনের চিন্তন প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছেন ‘সিস্টেম ২’। এই দুটি সিস্টেম কম বেশি সবার মধ্যেই কাজ করে এবং প্রায় সবার মধ্যেই সিস্টেম ১-এর প্রভাব সিস্টেম ২-এর চেয়ে বেশি, যথাক্রমে প্রায় ৯৮ ও ২ শতাংশ। তবে সব মানুষযে একরকম নয়, তা আমাদের আশপাশের হ্যামলেট বা কিংলিয়াররা চোখে আঙুল দিয়ে প্রতিনিয়ত দেখিয়ে দেয়।

সিস্টেম ১ হচ্ছে দ্রুত, অবচেতন, স্বতোলব্ধ, উপলব্ধ, হাইপোথিটিক্যাল, অনায়াস, স্বয়ংক্রিয়, অনুদ্দেশ্যমূলক; অভিজ্ঞতা, আবেগ ও স্মৃতিজাত এবং প্রাচীন। অন্যদিকে সিস্টেম ২ হচ্ছে ধীর, সচেতন, পরীক্ষালব্ধ, বিবেচনাপ্রসূত, যৌক্তিক, আয়াসসাধ্য, উদ্দেশ্যমূলক; তথ্য, উপাত্ত ও প্রমাণজাত এবং সাম্প্রতিক।

এখন এই সিস্টেম দুটির কোনটি কতটা চর্চা হয়, তা বোঝার জন্য কানেম্যান এবং শেইন ফ্রেডেরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর একটি পরীক্ষা করেছিলেন। পরীক্ষাটি আপনি নিজেও নিজের ওপর করতে পারেন। ধরুন, একটি ব্যাট ও একটি বলের দাম এক ডলার ১০ সেন্ট। ব্যাটের দাম বলের চেয়ে এক ডলার বেশি। তাহলে বলের দাম কত? আপনি যদি কিংলিয়ারের মতো কেউ হন, তাহলে আপনি এরই মধ্যে আপনার উত্তর পেয়ে গেছেন। সেটি হচ্ছে ১০ সেন্ট। কিন্তু আপনি যদি সিস্টেম ২ প্রয়োগ করেন, তাহলে দেখবেন যে উত্তরটি আসলে পাঁচ সেন্ট।

আপনার উত্তর ভুল হলে এর কারণ আপনি অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনায়াসে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনি যা উপলব্ধি করেছেন, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে আপনি সেটিকেই সঠিক উত্তর বলে ধরে নিয়েছেন। তবে উত্তর ভুল হলেও আপনার মন খারাপ করার কিছু নেই। কারণ কানেম্যানদের গবেষণায় হার্ভার্ড, এমআইটি ও প্রিন্সটনের ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর উত্তর ভুল ছিল। আর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভুল উত্তরদাতার সংখ্যা ৮০ শতাংশেরও বেশি।

কানেম্যানরা এ রকমই আরেকটি নিরীক্ষায় সিলোলিজম ব্যবহার করেছিলেন। ‘সব গোলাপই ফুল। কিছু ফুল খুব দ্রুত শুকিয়ে যায়। অতএব, কিছু গোলাপও দ্রুত শুকিয়ে যায়।’ সিলোলিজমটি ভুল হলেও সিস্টেম ১-এর প্রভাবে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এটিকে যথার্থ বলে ধরে নেন। এ বিষয়ে তাঁরা এতই নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁরা আর তাঁদের সিদ্ধান্তকে পুনর্বার যাচাই করতে যাননি। কানেম্যান বলেছেন, বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এমনই হয়। তাঁরা দ্রুত সিদ্ধান্তনিয়ে তাতো আর যাচাই করেনই না, উল্টো তার পেছনে যুক্তি দাঁড় করান।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন সিস্টেমটি বেশি উপকারী? বলা মুশকিল। যেমন-আপনি যদি আপনার দিকে কোনো ট্রাককে ধেয়ে আসতে দেখে সিস্টেম ২ ব্যবহার করতে যান, তাহলে আপনার প্রাণ সংশয় হবে। আবার বিয়ে করার ক্ষেত্রে সিস্টেম ১ ব্যবহার করলে আপনাকে রোমিও বা জুলিয়েটের ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। তবে বার্নার্ডশর ভাষ্য মতে, বিয়ে করার সময় যে সিস্টেম ২ ব্যবহার করা উচিত এ কথা জেনেও ছেলেরা সিদ্ধান্তনেওয়ার সময় সাধারণত সিস্টেম ১-কে ব্যবহার করে ফেলেন।

আমাদের জীবনে যে সিস্টেম ১-এর এত প্রাধান্য তার কারণটি সোশিও বায়োলজির স্রষ্টা ই ও উইলসনের কথার সূত্র ধরে খোঁজা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের এখনকার যেমন মানসিকতা, সেটি বহু আগে মূলত প্রত্ন প্রস্তর যুগে তৈরি হয়ে গেছে। ’তাই যদি হয়, তাহলে আমরা যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিস্টেম ১ ব্যবহার করব, সেটিইস্বাভাবিক। কারণ সেই যুগে সিস্টেম ২-এর ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। তবে উইলসন এর সঙ্গে আরেকটি কথা যোগ করেছেন-আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যযুগীয়, আর প্রযুক্তি মহাশক্তিধর। অর্থাৎ আমাদের মানসিকতার সঙ্গে বর্তমান প্রযুক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের কোনো মিল নেই এবং এই অমিলই বেশিরভাগ সমস্যার কারণ। তাহলে আমাদের হয় প্রযুক্তির ব্যবহার কমিয়ে দিতে হবে অথবা সিস্টেম ২-এর ব্যবহার বাড়াতে হবে।

প্রযুক্তির ব্যবহার কমানো সহজ নয়। ফলেসিস্টেম ২-এর চর্চা বা সূক্ষ্চিন্তন দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আবার ওদিকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু অনেক ক্ষেত্রে এখনো মধ্যযুগীয়, সেখানে সূক্ষ্চিন্তন চর্চার সুযোগ কম। কানেম্যানের গবেষণা প্রমাণ করে এমন কি হার্ভার্ড, এমআইটি বা প্রিন্সটনও এর ব্যতিক্রম নয়। যাহোক, আমাদের স্কুলগুলোতে এখনই সূক্ষ্চিন্তন চর্চা শুরু করাটা জরুরি। নতুন শিক্ষাক্রমে সেরকম একটা চেষ্টাও আছে, তবে তা কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছার ওপর।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *