আলেমা হাবিবা আক্তার: সুলতানা তাজুল আলম সাফিয়াতুদ্বিন সিয়াহ ছিলেন উত্তর সুমাত্রার ইসলামী রাজ্য আচেহ দারুসসালামের ১৪তম শাসক। তিনি দীর্ঘ ৩৪ বছর দেশ শাসন করেন এবং শাসক হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দেন, যিনি তাঁর বিচক্ষণ শাসন ও কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে মাতৃভূমিকে ডাচ ও পর্তুগিজ আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করেন। ১৬৪১ সালে তাঁর স্বামী ইস্কান্দার থানি মারা গেলে তিনি শাসক মনোনীত হন। সিংহাসনে আরোহণের সময় তিনি তাজুল আলম সাফিয়াতুদ্বিন সিয়াহ নাম ধারণ করেন। এই নামেই তিনি মুদ্রা চালু করেন।
সুলতানা তাজুল আলম ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচেহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পারিবারিক নাম ছিল পুত্রি শ্রি আলম। তিনি ধর্মীয় শিক্ষা ও পারিবারিক ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠেন।
সুলতানা সাফিয়াতুদ্বিন সুফি আলেম হামজা ফানসুরি (রহ.)-এর কাছে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং কবিতার পাঠ গ্রহণ করেন। যুগের বিখ্যাত আলেম শায়খ নুরুদ্দিন আল রানিরি (রহ.)-এর কাছে ফিকহ তথা ইসলামী আইন পড়েন।
ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি যথেষ্ট ধার্মিক ছিলেন। তিনি নামাজ-রোজাসহ ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করতেন এবং পর্দার বিধান মেনে চলতেন।
পর্দার অন্তরাল থেকেই সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ গ্রহণ, রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি, জনসাধারণের অভাব-অনুযোগ শ্রবণ ও বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। সুলতানা তাজুল আলম শরিয়াহ আইন অনুসারে দেশ পরিচালনা করতেন। তবে তাঁর শাসনামল শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সহাবস্থানের জন্য প্রশংসিত।
সুলতানা সাফিয়াতুদ্বিন একদল শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার জন্য মক্কা, মদিনা, বাগদাদ ও ভারতে পাঠান। তিনি চাইতেন তারা দেশে ফিরে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করবে এবং ধর্মীয় বই-পুস্তক রচনা করবে।
তিনি নিজেও ‘মাসায়িলুল মুক্তাদি’ নামের একটি বই লিখেছিলেন। তিনি সিয়ামসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে ইসলাম প্রচারের জন্য লোক পাঠাতেন। মুসলিম পর্যটক আল মুতাওয়াক্কিলও তাঁর ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞান এবং বিচক্ষণ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।
সুলতানা সাফিয়াতুদ্বিন একটি জটিল ও চ্যালেঞ্জিং সময়ে আচেহ শাসন করেন। আচেহ ছিল এক ব্যস্ত বন্দরনগরী, যা একদিকে ঔপনিবেশিক শক্তি ডাচ-ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির হুমকির মুখে পড়েছিল, অন্যদিকে তার জন্য নিজের আশ্রিত রাজ্যগুলোর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠছিল। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি সর্বপ্রথম ডাচদের ক্রমবর্ধমান চাপ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর স্বামীর ক্রয়াদেশে তৈরি একটি অতি মূল্যবান গহনার সেট গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। কেননা তা আচেহের অর্থনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। চার বছরের কূটনৈতিক দর-কষাকষির পর তিনি একটি চুক্তিতে সম্মত হন। যেখানে তিনি গহনার ন্যূনতম মূল্য পরিশোধ এবং ডাচরা আর্থিক ক্ষতি মেনে নেওয়ার অঙ্গীকার করে। মূল্য পরিশোধের পর তিনি ডাচ প্রতিনিধিদের অপমান করতে তাঁর দরবারে নাচার নির্দেশ দেন।
সুলতানা সাফিয়াতুদ্বিনের শাসনামলে ডাচরা পেরাকের টিন সম্পদের দখল নিতে আগ্রাসী হয়ে ওঠে। তারা পেরাক নদী অবরোধ করে। ৬ মে ১৬৫১ অবরোধকারী দুটি জাহাজের নাবিকদের হত্যা এবং তাদের গুদামঘর লুট হয়েছে। ডাচ কমিশনার সুলতানা সাফিয়াতুদ্বিনকে হামলার ঘটনায় বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে চাপ দিতে থাকে। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এই সংকট মোকাবেলা করেন। তিনি হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া ডাচদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন এবং হত্যাকাণ্ড জড়িত কয়েকজনের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। একই সঙ্গে ডাচ কমান্ডারদের সতর্ক করে বলেন, ‘কমান্ডার! পেরাকের বিরুদ্ধে কাজ করা আপনার উচিত নয়। কেননা এটা আমার দেশ। …আপনি আমার দেশে আমার সম্মতির বিরুদ্ধে কিছু করবেন না। এমন কোনো কিছু করা আপনার উচিত হবে না, যা ডাচদের সঙ্গে যুদ্ধের কারণ হয়।’
যুদ্ধের পরিবর্তে ‘নারীর কূটনৈতিক কোমল শক্তি’ ফলপ্রসূ হতে পারে সুলতানা সাফিয়াতুদ্বিন তার উত্তম দৃষ্টান্ত। ডাচ, পর্তুগিজসহ ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের প্রচণ্ড চাপ থাকার পরও তাঁর শাসনামলে আচেহ বন্দরে ভারতীয় মুসলিম ব্যবসায়ীরা সমান সুবিধা ও করে ব্যবসার সুযোগ পেয়েছিল। তাঁর নীতি ও কঠোর অবস্থানের কারণে ডাচরা পেরাক থেকে অতিরিক্ত টিন সংগ্রহ করতে পারেনি এবং পর্তুগিজরা হাতি ব্যবসাকে লাভজনক করতে পারেনি। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ইউরোপীয়দের অভিলাষ ও আগ্রাসন রুখে দেন।
২৩ অক্টোবর ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে মহান এই নারী শাসক ইন্তেকাল করেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁকে আচেহ দারুসসালামের রাজকীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর সুলতানা নুরুল আলম নাকিউদ্দিন সিয়াহ পরবর্তী শাসক মনোনীত হন।