দেওয়ানবাগ ডেস্ক: এবার সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দুইভাগ করে পরিচালিত হবে এই কার্যক্রম। এর মধ্যে একটি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের একাডেমিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। এতে যুক্ত থাকবেন প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকরা। আরেকটি গবেষণা পরিচালিত হবে সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক ও সিনিয়র অধ্যাপকদের মাধ্যমে। মানবজীবনের দৈনন্দিন চাহিদাভিত্তিক প্রায়োগিক এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেবেন তারা। এটি শিল্পকারখানা আর বৈশ্বিক বাস্তবতার আলোকে করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দও থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) নতুন জ্ঞান সৃষ্টির এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক দুটি নীতিমালা তৈরি করছে।
জানতে চাইলে ইউজিসির পরিচালক (স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স বিভাগ) ড. মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, দুই ধরনের গবেষণার একটির নাম হচ্ছে ‘একাডেমিক প্রমোশনাল’ এবং আরেকটির নাম ‘ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কলাবরেশন’। এ লক্ষ্যে নীতিমালা তৈরির কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। নভেম্বরের মধ্যে নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে। এরপর এ নিয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি কাজ করবে।
বর্তমানে জাতীয় বাজেট থেকে শিক্ষায় যে বরাদ্দ আছে, উচ্চশিক্ষায় সেখান থেকে বরাদ্দ এক শতাংশেরও কম-মাত্র দশমিক ৯১ শতাংশ। ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এবার ১০ হাজার ৪৪৪ কোটি ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে গবেষণা খাতে ১৫০ কোটি টাকা। তবে এই টাকাও সব বিশ্ববিদ্যালয় পায়নি। একটি অংশ রেখে দিয়েছে ইউজিসি। ওই টাকা থেকে ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আলাদাভাবে গবেষণা, গবেষণাসংক্রান্ত কাজে দেশের ভেতর ও বাইরে সফরসহ আনুষঙ্গিক কাজে বিনিয়োগ করে। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে আরও দেখা যায়, ২০১৮-২০১৯ বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়মিত ও বিশেষ বরাদ্দ ছিল ৬১.৯০ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০২০ বর্ষে ছিল ৬৪.৫৮ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদিও প্রতিবছরই গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ছে; কিন্তু একটি মৌলিক ও আলোচিত গবেষণার জন্য এই বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত বিশ্বে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বাজার চাহিদা সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে গবেষণার জন্য। আবার অনেক সময় অধ্যাপকরাই শিল্পকে বিষয়ভিত্তিক গবেষণার প্রস্তাব দেন। এরপর শিল্প-একাডেমিয়ার যৌথ প্রয়াসে গবেষণা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর শত শত গবেষক পিএইচডি বা মাস্টার্স ডিগ্রি করতে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট (আরএ) হিসাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যায়, সেটা মূলত অধ্যাপকদের কাছে আসা এই তহবিলের আলোকে প্রাপ্ত ফান্ড থেকে স্কলারশিপ নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে সম্প্রতি আলাপকালে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল।
ইউজিসি বলছে, এই ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়ার সমন্বয়ে যে গবেষণা উন্নত বিশ্বে দেখা যায়, সেটিই বাংলাদেশে তারা চালু করতে চান। এ লক্ষ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি, নতুন গবেষক তৈরি, বরাদ্দ বাড়ানো কিংবা শিল্পকারখানার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযোগ স্থাপনের পথ সুগম করবে ইউজিসির নীতিমালা। এক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাজন থাকবে না। ইন্ডাস্ট্রি থেকে আসা অফার যে কোনো ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপযুক্ত সিনিয়র অধ্যাপক বা খ্যাতিমান শিক্ষকের কাছে যাবে। সিনিয়রদের তত্ত্বাবধানে নবীন গবেষকরা কাজ করতে পারবেন। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একাডেমিক গবেষণা কার্যক্রমও জোরেশোরে চলবে, যার নেপথ্যে ভূমিকা রাখবেন জুনিয়র শিক্ষকরা। গবেষণার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন করতে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করা হবে। সবমিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাবান্ধব সংস্কৃতি তৈরির স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। এতে একপর্যায়ে দক্ষতাসম্পন্ন বিশ্বমানের গবেষক তৈরি হবে।
জানা যায়, নীতিমালা তৈরির লক্ষ্যে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেনকে প্রধান করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির সদস্য সচিব হিসাবে কাজ করছেন ড. ফখরুল ইসলাম। এতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অধ্যাপক এবং বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে।
ড. ফখরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে সক্রিয় ও মৌলিক গবেষণায় নবীন গবেষকদের উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। আলোচিত আবিষ্কার আর গবেষণা ফল পাওয়ার জন্য দক্ষ গবেষক তৈরির প্রাথমিক পর্যায় এটি। অন্যদিকে গবেষণায় লব্ধ নতুন জ্ঞানের মাধ্যমে দেশের সম্পদের ফলপ্রসূ ব্যবহার করে উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ জ্ঞান সৃষ্টি এবং এর ফল কাজে লাগাতে পারলে দেশ এগিয়ে যাবে। এজন্যই এই আলাদা দুটি নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন সময়ে বিদেশি সংস্থাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক র্যাং কিং করে। এতে যে কয়টি দিক বিবেচনায় নেওয়া হয়, এর অন্যতমই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রম। বাংলাদেশে হয়তো গবেষণা হয়; কিন্তু তার প্রকাশ ও প্রচার নেই। আবার গবেষণা কম হলে তদারকির মাধ্যমে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরও উন্নতমানের গবেষণা কার্যক্রম হওয়া সম্ভব বলে সিনিয়র অধ্যাপকরাই মতামত দিয়েছেন। আবার আমাদের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেটা কেবল পাঠদানের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেখানেও অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক আছেন। কিন্তু তারা অনেকে কোনো ধরনের গবেষণা করেন না। এজন্য নীতিমালার পাশাপাশি পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকলে অনেকের আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি দেশও বিশ্ব র্যাংেকিং জায়গা পাবে।
সূত্র জানিয়েছে, এই নীতিমালা তৈরির পেছনে আরও একটি বড় কারণ আছে। সেটি হচ্ছে, প্রতিবছর সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই অর্থ ভাগবাঁটোয়ারা হয়। কোথাও বই আর কাগজপত্র কেনার নামে মাসভিত্তিক শিক্ষকদের বেতনের সঙ্গে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। তারা সেই টাকায় কী কাজ করেছেন, সেই হিসাব নেওয়ার কেউ নেই। অন্যদিকে কেউ কেউ প্রকল্প প্রস্তাব দিয়ে বরাদ্দ নিলেও আদৌ কোনো গবেষণা করেছেন কি না কিংবা সেই গবেষণার ফল কী-তা সরকার জানতে পারে না। আবার দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ‘তথাকথিত’ প্রকল্পে অর্থায়নের অভিযোগও কম নয়। এজন্য গত সেপ্টেম্বরে ৫১ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি চিঠি দিয়ে গবেষণা প্রকল্পগুলোর প্রতিবেদন চেয়েছে। কিন্তু গত দেড়মাসে মাত্র ৭টি প্রতিবেদন ইউজিসিতে জমা পড়েছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে বলে ওই সূত্র জানায়।