দেওয়ানবাগ ডেস্ক: বিশ্বকে এক সুতায় বাঁধতে চীনা মহাপরিকল্পনার নাম হলো ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ (বিআরআই)’। যা চীনের প্রায় ২ হাজার বছরের পুরনো একটি বাণিজ্যিক রুট রেশম পথের (সিল্ক রুট) আধুনিক সংস্করণ এবং পুনরুজ্জীবন উদ্যোগ। সেই ঐহিত্যবাহী পথটি এখন পুনর্র্নিমাণের চেষ্টা হচ্ছে। কোথাও এর কাজ শেষ হয়েছে, কোথাও হচ্ছে এবং কোথাও আবার তৈরি হয়েছে ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা। পথটি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পণ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায় চীন।
বিআরআই পরিকল্পনা: বিআরআই পরিকল্পনায় রয়েছে বিশ্বের ৬৮টি দেশ, ৬৩ শতাংশ জনসংখ্যা এবং ৪০ শতাংশ বাণিজ্য। অর্থাৎ এখানে আছে সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্র, সবচেয়ে বড় অর্থায়ন ও সবচেয়ে বেশি জনসমষ্টি। এরই মধ্যে উদ্যোগের আওতায় চীন সরকার গত ১০ বছর ধরে ১৪৯টি দেশ ও ৩২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ২ শতাধিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
তিন মহাদেশের ৬৮টিরও বেশি দেশে চীন এরই মধ্যে ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। চীন চাইছে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ বিআরআই উদ্যোগের সফল সমাপ্তি টানতে।
কী আছে রূপরেখায়: বিশ্বকে এক সুতায় গাঁথতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের রূপরেখায় রয়েছে ছয়টি ইকোনমিক করিডর নির্মাণের পরিকল্পনা। এগুলো হলো: বাংলাদেশ-ভারত-চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডর (বিসিআইএম), চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি), চীন-মঙ্গোলিয়া রাশিয়া ইকোনমিক করিডর (সিএমআরইসি), নিউ ইউরো এশিয়ান ব্রিজ, চীন-মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া অর্থনৈতিক করিডর এবং চীন-ইন্দো চায়না পেনিনসুলা।
এগুলো বাস্তবায়িত হলে চীন সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরেশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হবে।
বিআরআই উদ্যোগে ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চীন-পাকিস্তান করিডর এবং বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডর। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শুধু ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের মারপ্যাঁচে বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর বাস্তবতায় গড়াতে পারেনি। এটিকে এখনো বাতিল না বলা হলেও এর কার্যক্রম কোমাতে চলে গেছে। কারণ, বিসিআইএম করিডরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ভারত।
কিন্তু ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একটা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এখানে পারস্পরিক আস্থার সংকট স্পষ্ট। এরই মধ্যে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইন্দোপ্যাসিফিকে যোগ দিয়েছে। এ ছাড়া এবারের জি২০ বৈঠক থেকে স্পাইস রোডের নতুন উৎপত্তি হলো।
এসব মিলে মনে হচ্ছে, ভারত বিআরআইতে আর আসবে না। তারা না এলে বিআরআই করিডর ধরে এশিয়াতে যাওয়া সহজ হবে না। এর ফলে শুরুর রূপরেখায় বিআরআইয়ের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, তা এখন অনেক সংযত করতে হবে বা নিচে নামিয়ে আনতে হবে।’
চীনা দূতাবাসে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘চীন চেষ্টা করছে ভারতসহ অন্য দেশগুলোকে তাদের প্রতি আস্থায় ফেরানোর। বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে চীনের উদ্দেশ্য সৎ। বিআরআই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে শুধু চীনই নয়, গোটা দক্ষিণ ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলসহ সমগ্র বিশ্ব এর দ্বারা উপকৃত হবে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, আস্থার ঘাটতি জিইয়ে রেখে বিআরআইয়ের রূপরেখার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের গন্তব্য কী: বিআরআই পরিকল্পনায় বাংলাদেশও ২০১৬ সালে যুক্ত হয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশকে বিভিন্ন অবকাঠামো খাতে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এরই মধ্যে এসব প্রকল্পের বিপরীতে ৪.৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গপথ বা টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও বিদ্যুৎ খাতের বেশ কিছু অবকাঠামো মূলত বিআরআই মহাপরিকল্পনারই অংশ বলে জানা গেছে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। সেটি হতেই পারে। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হলো ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রায় সবার সঙ্গেই অত্যন্ত সতর্কভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে এগোচ্ছে। তাই কোনো একটা জোটকে যেমন আমরা প্রাধান্য দেব না, একইভাবে কোনো পাল্টাপাল্টি অবস্থানেও অবশ্যই যেতে চাই না। আমাদের বাণিজ্য, অর্থনৈতিক তথা জাতীয় স্বার্থ ও সম্ভাবনার সব জায়গা নিশ্চিত করতে সবার সঙ্গেই সরকার চেষ্টা করবে সহযোগিতা পাওয়ার এবং দেওয়ার।’