অর্থনৈতিক ডেস্ক: রাজধানীসহ দেশের কোথাও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস মিলছে না। শিল্প-কারখানা, সিএনজি স্টেশন, আবাসিকখাতসহ সব ক্ষেত্রে এই সংকট চলছে। বেশ কিছুদিন ধরে চলা এ সংকটের কারণে কমে গেছে শিল্প-কারখানার উৎপাদন। এর মধ্যে সিরামিক, ইস্পাত ও টেক্সটাইল খাতের উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস মিলছে না। শিল্প-কারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে। এর ফলে উৎপাদন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে স্থানীয় উৎসর বাইরে দুটি উৎস থেকে এলএনজি আমদানি করা হয়। এর একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, অন্যটি স্পট মার্কেট (খোলাবাজার)। দেশে গ্যাসের মোট দৈনিক চাহিদা তিন হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। স্বাভাবিক সময়ে চাহিদার বিপরীতে স্পটমার্কেট থেকে এলএনজিসহ গড়ে দৈনিক প্রায় তিনহাজার থেকে তিন হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো। দাম বেড়ে যাওয়ায় স্পট এলএনজি কেনাবন্ধ থাকায় এখন প্রায় দুই হাজার ৭৫০ থেকে দুই হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।
ব্যাহত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদন
শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাসসংকটের কারণে সিরামিক, ইস্পাত ও টেক্সটাইল খাতে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। চলতি মাসের শুরু থেকেই গ্যাসের সংকট প্রকট হতে থাকে, যার কারণে অনেক সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। গ্যাসের চাপ বাড়লে কারখানা চলে, কমলে বন্ধ রাখতে হয়।
সিরামিক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন কমে যাওয়ায় মাসে প্রায় হাজার কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে এ খাতে। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি মো. সিরাজুল মোল্লা বলেন, ‘সিরামিক শিল্পটিই মূলত গ্যাসেরও পরনির্ভরশীল। গ্যাসসংকটের কারণেএখন ৬০ শতাংশ সিরামিক পণ্য উৎপাদন বন্ধ আছে। এতে ব্যাংক সুদ, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎবিলসহ সব মিলিয়ে এই শিল্পে দৈনিক ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে।’
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন বলেন, ‘স্টিল কারখানার উৎপাদন ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। কারখানাগুলোতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ) উৎপাদনও কমে গেছে। ১৮ মেগাওয়াট ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র চার থেকে ছয় মেগাওয়াট। ফলে আমাদের আয় ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।’
কর্ণফুলী গ্যাসডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমস লিমিটেড (কেজিডিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা কমবেশি ৩১৫ থেকে ৩২০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া যাচ্ছে ২৭০ থেকে ২৭২ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের সংকটের কারণে প্রতি সপ্তাহে এক দিন করে এলাকাভিত্তিক রেশনিং ব্যবস্থার আওতায় বিদ্যুৎসরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে জ্বালানি সংকটের কারণে সম্প্রতি এসএল স্টিলস, ভাটিয়ারী স্টিলস, শম্পা স্টিলসহ অন্তত ২০টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিছু কারখানা মালিক বিকল্প হিসেবে ডিজেল দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যদিও যেসব প্রতিষ্ঠানের বয়লারের সঙ্গে ডিজেলের সংযোগ লাইন নেই, তারা এ সুযোগটিও কাজে লাগাতে পারছে না।
চট্টগ্রামের এইচএম স্টিলের পরিচালক সরোয়ার আলম বলেন, গত কিছুদিনে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও এখনো সরবরাহকৃত গ্যাসের চাপ কম। ফলে নিয়মিত উৎপাদনের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম উৎপাদন হচ্ছে।
বিএসএমের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, ‘দিনের বেলা মিল চালাতে পারছি না। আমাদের উৎপাদন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। আমরা ক্ষতির মুখে পড়েছি।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংকট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও দিনে ছয় থেকে ১২ ঘণ্টা বন্ধ রাখতে হচ্ছে মিল। এতে আমাদের প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন কম হচ্ছে।’
আবাসিকে জ্বলছে না চুলা
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার আবাসিকে দেখা দিয়েছে গ্যাসের তীব্র সংকট। বেশ কিছুদিন ধরে চলা এ সংকট দিন দিন আরো তীব্র হচ্ছে। বাসাবাড়িতে সকাল ও রাতে গ্যাস থাকলেও দুপুরে রান্নার গ্যাস পাচ্ছেন না গৃহিণীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাড্ডা, রামপুরা, মিরপুর, বনশ্রী, মালিবাগ, শান্তিবাগ, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা গ্যাসসংকটে ভোগান্তিতে পড়েছে।
রাজধানীর উত্তরবাড্ডা এলাকার বাসিন্দা তাজমল হিরক বলেন, ‘টানা গত ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে সকাল ৮টার আগেই গ্যাস চলে যায়, সারাদিন আর গ্যাসের দেখা মেলে না। আবার সন্ধ্যার পর চুলায় গ্যাসের সরবরাহ পাওয়া যায়। যদি কোনোদিন দুপুর বা বিকেল বেলায় গ্যাস আসে, চাপ কম থাকায় চুলা জ্বলে টিমটিম করে। তাতে রান্না করার কোনো উপায় থাকে না। তাই বাধ্য হয়েই দুপুরে রান্নার কাজে এলপিজি সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে হচ্ছে।’
একই অভিযোগ রামপুরার বাসিন্দা সাইফুদ্দিনের। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের এলাকায় গ্যাস সংকট। সকালের দিকে গ্যাস থাকলেও দিনের বেলা থাকে না। থাকলেও না থাকার মতোই। আঁচ এতই কম যে রান্না করা সম্ভব হয় না।’
সিএনজি স্টেশনে গ্যাস কম
গ্যাসের চাপ (প্রেসার) কম থাকায় প্রতিটি গাড়িকে গ্যাস নিতে সিএনজি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে দীর্ঘ সময়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশ কয়েকদিন ধরেই গ্যাসের চাপ কম থাকায় দিনের বেলা বেশ কিছু সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে গ্যাসচালিত যানবাহনগুলোর ওপর।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারসন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নুর বলেন, ‘সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাসের প্রেসার একদম কম। যেখানে সরবরাহ করার কথা ১৫ পিএসআই গ্যাস, সেখানে আমরা পাচ্ছি মাত্র দুই থেকে তিন পিএসআই গ্যাস। গ্যাসের প্রেসার কম থাকার কারণে সিএনজি স্টেশনগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন হচ্ছে।’
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি ক্রয়ের চুক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এই ঘাটতি মেটানোর জন্য দেশীয় কূপগুলো থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করা হচ্ছে। আশা করছি, খুব দ্রুতই এই সংকট কেটে যাবে। ’
তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকেই গ্যাসের উৎপাদন ক্রমাগত কমছে, কিন্তু উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ না নেওয়ায় আজ গ্যাসসংকট।’ তাঁর পরামর্শ, যত দ্রুত সম্ভব দীর্ঘমেয়াদি এলএনজির চুক্তি বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে কাতার ও ওমান ছাড়াও অন্যান্য দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে এলএনজি আমদানি বাড়াতে হবে।