শাস্তির কারণে ঘর ছাড়ে অনেক শিশু

শাস্তির কারণে ঘর ছাড়ে অনেক শিশু

নারী ডেস্ক: মো. সুজনের বয়স ৭ বছর। ৬ বছর বয়সে মায়ের মার খেয়ে সে বাড়ি ছাড়ে। ময়মনসিংহের কোথায় তার বাড়ি, ঠিকঠাক বলতে পারে না। তবে ট্রেনে চেপে ঢাকার কমলাপুরে নামে তা জানায়। সেখানে কয়েক দিন ভিক্ষা করার পর মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত কাওরান বাজার পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে জায়গা হয়। সুজনকে প্রশ্ন করলে সে বলে, মা শুধু মারে। ভালোবাসে না। মার খেলে তার ভালো লাগে না।


সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দুটি পথশিশু পুনর্বাস কেন্দ্রের তথ্যমতে, ১৪৯ জন পথশিশুর মধ্যে ৯০ শতাংশই মা-বাবা ও শিক্ষকের শারীরিক শাস্তিতে বাড়ি ছেড়ে এসেছে। কেউ কেউ রাগ কমলে বাবা-মায়ের কাছে যেতে চাইলে তারা সঠিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পৌঁছে দেন। তবে বেশির ভাগ শিশু পথে বাস করে নানা রকম অপরাধ ও নেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে দীর্ঘদিন পথে থাকার পর তারা পথে থাকতেই অভ্যস্ত। আর বাড়িতেও ফিরে যেতে চায় না। এ অবস্থায় গত ৩০ এপ্রিল অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক শিশুদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বিলোপ দিবস।


১১ বছরের মো. আফিকুল ইসলামের বাড়ি রংপুরে। সে মাদ্রাসায় পড়ত। মাদ্রাসার শিক্ষক খেলার জন্য তাকে এমন মার দেয় যে, সে সেদিনই বাড়ি না গিয়ে পালিয়ে যায়। ৯ বছরের মো. শরিফের বাড়ি নরসিংদী। বাবা তাকে প্রায়ই বেদম পেটাতেন। বাবার মার সহ্য করতে না পেরে সে বাড়ি ছাড়ে। কাওরান বাজার ও কমলাপুর পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আফরোজা আক্তার ও কামরুন নাহার রতœা বলেন, তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৭৫ জন করে শিশু থাকছে, যার ৯০ শতাংশই বাবা-মা ও শিক্ষকের মার খেয়ে বাড়ি ছাড়ে। ২০১৬ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পথশিশুদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে বিভাগীয় শহরগুলোতে জরিপ করে। জরিপের তথ্যমতে, বাবা-মায়ের দারিদ্র্য, বহুবিবাহ, কলহ, পিতামাতার মাদকাসক্তি প্রভৃতি কারণে পারিবারিক শাস্তির শিকার হয়ে পথে আসে শিশুরা। এই শিশুদের পুনর্বাসন প্রকল্প পরিচালক ছিলেন ড. আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সমস্যাগুলো এখানো শেষ হয়নি, তাই এখনো পথশিশুরাও আছে। তারা নানা রকম শ্রম, অপরাধ কিংবা মাদকাসক্তির সঙ্গে জড়িত হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, শারীরিক ও মানসিক শাস্তি পেয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরা নিজেরাও অপরাধী হয় কিংবা অপরাধের শিকার হওয়াকে স্বাভাবিক মনে করে। তাই সব ক্ষেত্রে শিশুর শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে আইন প্রণয়ন এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ওপর গুরুত্বারোপ ও আইন প্রণয়নের কথা বলেন তারা।


কিছু পরিসংখ্যান: মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসেই ১৮৬ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ১২ জন শিশু শিক্ষক কর্তৃক নির্যাতনের শিকার এবং ১৬ জন শিশু শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ২০২৩ সালে মোট ১ হাজার ১৩ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরকম অসংখ্য ঘটনা প্রকাশ হয় না।


দূর করতে হবে শাস্তি: ২০১০ সালে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের ক্রমবর্ধমান শারীরিক নির্যাতন প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষের ক্রমাগত ব্যর্থতাকে চ্যালেঞ্জ করে মানবাধিকার সংস্থার দায়েরকৃত একটি রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের শারীরিক শাস্তি অসাংবিধানিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘোষণা করে রায় দেয়। এ রায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১১ ধরনের শারীরিক ও দুই ধরনের মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ১২ বছর পরও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না।


শাস্তি শিশুদের অপরাধী করে: মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, শুধু শারীরিক নয়, সঙ্গে মানসিক নির্যাতন শিশুকে গালি দেওয়া, অপমান করা-এসব কারণে শিশুরা বিচ্যুতিমূলক আচরণ করে। ক্রমেই তারা বড় ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সমাজে কিশোর গ্যাংয়ের আবির্ভাব হয়। শিশুদের পুনর্বাসন কাজ রাষ্ট্রকে আরও বড় পরিসরে করার ওপর জোর দেন তিনি।

বিশ্বে বাধ্যতামূলক শ্রমের ৫৫% নারী
নারী ডেস্ক: বিশ্বজুড়ে বাধ্যতামূলক শ্রম দিচ্ছে ২ কোটি ৯ লাখ মানুষ। যারা শ্রম বা যৌন শোষণের জন্য পাচার হয়েছে, কিংবা দাসের মতো পরিস্থিতিতে রয়েছে, এদের মধ্যে ৫৫ শতাংশই হচ্ছে মেয়ে বা নারী। বাকি ৪৫ শতাংশ ছেলে বা পুরুষ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও ‘প্রফিটস অ্যান্ড পভার্টি : দ্য ইকোনমিকস অব ফোর্সড লেবার’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে।


এতে বলা হয়, বাধ্যতামূলক শ্রমে শিশুদের চেয়ে বয়সীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বিশ্বজুড়ে ১৮ বছরের কম বয়সী ৫৫ লাখ বা ২৬ শতাংশ শিশু বাধ্যতামূলক শ্রমে ব্যবহার হচ্ছে। এক কোটি ৫৪ লাখ বা ৭৪ শতাংশের বয়স ১৮ বা তার বেশি। বাধ্যশ্রমের এক কোটি ৮৭ লাখ বা ৯০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক বেসরকারি খাতে।
এর মধ্যে ৪৫ লাখ বা ২২ শতাংশ যৌন নিপীড়নের শিকার। এক কোটি ৪২ লাখ বা ৬৮ শতাংশ মানুষ অন্যান্য খাতে বাধ্যতামূলক শ্রমে ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে কৃষি, নির্মাণ, গৃহস্থালিকাজ, শিল্পোৎপাদন খাত, খনি এবং জন-উপযোগমূলক সেবা রয়েছে। বাকি ২২ লাখ বা ১০ শতাংশ রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধ্যতামূলক শ্রম দিচ্ছে।
বিশ্বের কোন অঞ্চলে কত মানুষ বাধ্যতামূলক শ্রম দেয়, সেই হিসাবও দেখিয়েছে আইএলও। তাতে দেখা যায়, সবার আগে রয়েছে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো। ২০২২ সালে এই দুটি অঞ্চলের এক কোটি ৪৫ লাখ মানুষ বাধ্যতামূলক শ্রম দিত। আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোয় এই সংখ্যা ছিল ৩৮ লাখ, আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলোয় ৩৬ লাখ, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোয় ৪১ লাখ। এ ছাড়া আরব দেশগুলোতে ৯ লাখ মানুষ বাধ্যতামূলক শ্রম দেয়।


আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে এই বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে সৃষ্ট বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ ২৩৬ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০১৪ সালের পর এই বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে সৃষ্ট মুনাফার পরিমাণ ৬৪ বিলিয়ন বা ছয় হাজার ৪০০ কোটি ডলার বা ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে সৃষ্ট মুনাফা এভাবে নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো, বাধ্যতামূলক শ্রমে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা এবং এই বাধ্যতামূলক শ্রমের শিকার মানুষপ্রতি মুনাফা বেড়েছে।


সারা পৃথিবীতে বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে যে অবৈধ মুনাফা অর্জিত হয়ে থাকে তার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোয়। এর পেছনেই রয়েছে আমেরিকা অঞ্চল। আইএলওর প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বে প্রতিবছর বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে বছরে ২৩৬.৬০ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের মুনাফা অর্জিত হয়। এর মধ্যে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো অর্জন করে সর্বোচ্চ ৮৪.২ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ৪২০ কোটি মার্কিন ডলার। এর পরের অবস্থানে থাকা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এ ধরনের মুনাফা অর্জিত হয় ৬২.৪ বিলিয়ন বা ছয় হাজার ২৪০ কোটি ডলার।


আমেরিকা অঞ্চলে এই মুনাফার পরিমাণ এখন ৫২.১ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার ২১০ কোটি ডলার। আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলো বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে ১৯.৮ বিলিয়ন বা এক হাজার ৯৮০ কোটি ডলার এবং মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব দেশগুলো ১৮ বিলিয়ন বা এক হাজার ৮০০ কোটি ডলার মুনাফা করে থাকে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *