ডা. মো. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী: রোজার সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রোজা মানবিক গুণাবলির প্রকাশ ঘটায়। রোজা রেখে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়। আমার ‘রোজা এবং স্বাস্থ্য’ বইয়ে এ ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। রোজার সঙ্গে অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তা লেখার চেষ্টা করব এই লেখায়। আমরা সাধারণ মানুষ যা বুঝি- চঞ্চল অর্থকে স্থবির অবস্থায় রাখলে অর্থনীতির উন্নয়ন হয় না। রোজার মাসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থের চঞ্চলতা বেড়ে যায়। তাই রোজা অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। রোজার মাসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বেড়ে যায়। সাময়িকভাবে হলেও কিছু বেকারত্ব ঘুচে যায়। পরিবহন খাতের গতি চোখে পড়ার মতো। কিছু শিল্পে ব্যস্ততা বাড়ে। পর্যটনশিল্পেও একটি গতি আসে। ধর্মীয় খাতগুলো প্রাণ ফিরে পায়। এসব কিছু একসঙ্গে যোগ করলে রোজা ও রোজার ঈদ অর্থনীতিকে বিশেষভাবে গতিময় করে তোলে। এগুলোর ব্যাপারে কিছুটা আলোচনা করতে চাই।
ভোজ্যপণ্যের ব্যবহার বেড়ে যায়: প্রথমত, রোজার মাসে কিছু ভোজ্যপণ্যের ব্যবহার বেড়ে যায়। যেমন- ছোলা, ডাল, বেগুন, মরিচ, লেবু, আলু, ময়দা, তেল, শসা, টমেটো, গাজর। সবজির মধ্যে এগুলোর প্রয়োজন অনেক বেড়ে যায়। ফলের মধ্যে খেজুর, আপেল, আঙুর, বেদানা, কলা, কমলা, ডাব ও সিজনাল ফল। প্রোটিনের মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম, ডাল। চর্বির মধ্যে তেল, ঘি। শর্করার মধ্যে আলু, ময়দা, বেসন, চিনি। এগুলোর কাটতি রোজার মাসে অনেক বেড়ে যায়। ফলে এই খাদ্যগুলোর উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণন অনেকগুণ বেড়ে যায়। এতে অর্থনীতির চাকা অনেক গতিশীল হয়।
মিষ্টান্নদ্রব্যের ব্যবহার: রমজান মাস এলেই মিষ্টান্নদ্রব্য, বিশেষ করে সেমাই, শরবত, ফিন্নি ইত্যাদির ব্যবহার বেড়ে যায়। রমজানের ঈদে সেমাই ছাড়া তো চলেই না। এ মাসে সেমাই কারখানাগুলো খুব ব্যস্ত সময় কাটায়। সেমাই কারখানাগুলো মনে হয় রমজান মাসের জন্য অপেক্ষা করে। এতে আমাদের অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব পড়ে। আমাদের অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি পায়।
শরবতের ব্যবহার: ইফতারের মধ্যে শরবত একটি অত্যাবশ্যকীয় সংযোজন। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের শরবত পাওয়া যায়। যেমন- বেলের শরবত, ইসবগুলের শরবত, বাঙ্গির শরবত, কাঁচা আমের শরবত, আখের গুড়ের শরবত, কামরাঙার শরবত, কমলা লেবুর শরবত, আনারসের শরবত, আপেল ও লেবুর মিক্সড শরবত, টমেটোর শরবত। এসব শরবত তৈরির সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ইফতারবাজার ও অর্থনীতি রোজার মাসের একটি নতুন সংযোজন: সারাবছরে ইফতারবাজার এক মাসই বসে। তা হচ্ছে রোজার মাস। দুপুর ২টা থেকে ইফতারের বিভিন্ন পসরা নিয়ে ইফতারবাজার শুরু হয়। হরেক রকমের চিত্তাকর্ষক ও বিলাসী খাদ্যসামগ্রী নিয়ে দোকানিরা দোকান সাজিয়ে রাখেন। এ দোকানটি হতে পারে তাদের মূল দোকান অথবা মূল দোকানের সামনে অতিরিক্ত জায়গা নিয়ে একটি ইফতারের দোকান। অনেক সময় সমাজের নিম্নআয়ের লোকরা ফুটপাতে ইফতারের পসরা নিয়ে বসে। এই ইফতারবাজার বছরের অন্য মাসে দেখা যায় না, শুধু রোজার মাসেই দেখা যায়। এতে মোটামুটি ব্যবসা হয় এবং অনেকের সাময়িকভাবে কর্মসংস্থান হয়।
বিপণিবিতানগুলো উজ্জীবিত হয়: বিপনি বিতানগুলো রাতদিন খোলা থাকে। নতুন নতুন ফ্যাশন ও ডিজাইনের কাপড়চোপড়ে পরিপূর্ণ থাকে। অনেক বিপণনকর্মীকে নিয়োগ দিতে হয়। রোজার মাসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক মানুষের সাময়িকভাবে কর্মসংস্থান হয়। যেমন- বস্ত্রশিল্প, বিপণন কেন্দ্র, পরিবহন সেক্টরে। যতই ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বাড়বে, ততই শ্রমিকের প্রয়োজন বেড়ে যাবে।
বস্ত্রশিল্পে গতি আসে: রোজার মাসের শেষে আসে রোজার ঈদ। রোজার ঈদে সবাই নতুন কাপড় পরতে চান। যেমন- শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি, থ্রি-পিস, ঈদের দিন পাঞ্জাবি, পায়জামা, টুপির ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। তাই পুরো বস্ত্রশিল্পে উৎপাদনের একটি ঝড় বয়ে যায়। এর আয়োজন শুরু হয় মাসের প্রথম থেকেই। প্রত্যেকেই তার আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে একটি নতুন কাপড় কিনতে চান। এতে বস্ত্র ব্যবসা অনেক ত্বরান্বিত হয় এবং বস্ত্রশিল্পের চাকায় অনেক গতি আনে। ফলে বস্ত্র তৈরি, পরিবহন ও বিপণন করা- সবই রোজার মাসে বেড়ে যায়। যারা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত, তারা দিনরাত কাজ করে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করেন। এই শিল্পগুলোয় শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজ করতে হয় এবং এই মাসে অনেক নতুন শ্রমিক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তাই বস্ত্রের প্রয়োজনের কারণেই রোজার মাসে অর্থনীতির চাকা অনেক চাঙ্গা হয়। একই সঙ্গে অনেক মানুষের বেকার সমস্যার সাময়িকভাবে সমাধান হয়।
প্রতিষ্ঠানগুলো সজীব হয়: রোজার মাসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সজীব হয়। নতুন অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। শপিংমল, সুপারসপ, মার্কেটগুলো নতুন আঙ্গিকে সাজে। আবার নতুন নতুন অনেক পথদোকানও তৈরি হয়। ফলে অর্থনীতির ওপর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। বস্ত্র ব্যবসায়ীদের সারাবছরে যা ব্যবসা হয়, রোজার মাসে তা অনেকগুণ বেড়ে যায়। এতে অর্থনীতির চাকা অনেক চাঙ্গা হয়। বস্ত্র ব্যবসায়ীদের মতে- তাদের পুঁজি, রক্ষণাবেক্ষণ ও স্টাফ বেতনসহ সবকিছু এই রোজার মাসের ব্যবসা দিয়ে চলে। রোজার মাসই হচ্ছে তাদের সারাবছরের মোক্ষম ব্যবসার মাস।
অলস অর্থ সচল হয়: রোজার মাসে অর্থের প্রবাহ বেড়ে যায়। ব্যাংকের অলস অর্থ থেকে কিছু অর্থ গ্রাহকদের হাতে এসে সক্রিয় হয়। তা থেকে দান-সদকা, হাদিয়া, ফিতরা, জাকাতের মাধ্যমে কিছু অর্থ গরিবের কাছে আসে। পরে তা আবার বাজারে আসে। বাজার থেকে এটা ব্যবসায়ীর মূলধন হয় অথবা আবার ব্যাংকে জমা হয়। এ অর্থনীতির চাকা যতই ঘুরতে থাকে, ততই অর্থনীতি চাঙ্গা হয়।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাণ ফিরে পায় এবং এতিমদের পুনর্বাসনে সহায়ক হয়: ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাণ ফিরে পায় এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত আছেন, তাদের অর্থিক উন্নয়ন ঘটে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন- মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা পরিচালনা করতে যে অর্থের প্রয়োজন হয়; এর একটা বড় অংশ এ রোজার মাসেই আসে। সরকারের সাহায্যের পাশাপাশি দান-সদকা, হাদিয়া, ফিতরা, জাকাতের টাকা এবং কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো চলে। তাই ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও রোজার মাসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া এতিমদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও রোজার মাসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির ওপর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
রোজা, জাকাত ও অর্থনীতি: জাকাত অর্থনীতির ওপর, বিশেষ করে মাইক্রোইকোনমির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে- যদি কার্যকরভাবে তা প্রদান করা হয়। সবাই রোজার মাসকে জাকাত দেওয়ার মাস হিসেবে নির্ধারণ করে রাখেন। তাই জাকাত প্রদানের মাধ্যমে রোজা অর্থনীতিকে কিছুটা সমৃদ্ধ করে। কর্মক্ষম, পরিশ্রমী, বেকার কাউকে জাকাত প্রদানের মাধ্যমে স্বল্পপুঁজি দিয়ে একটা
ব্যবসার জোগান দেওয়া যেতে পারে। বস্ত্র দেওয়া নয়- জাকাত একই সঙ্গে হতদরিদ্র-ছিন্নমূল মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের সহায়ক হতে পারে। এভাবে রোজার মাসে জাকাত প্রদানের মাধ্যমে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে পারে।
রোজার মাসে ওমরাহ পালন: রোজার মাসে ওমরাহ পালনের প্রবণতা অনেকগুণ বেড়ে যায়। সাধারণত রমজান মাসে ফজিলতের কারণে অন্যান্য মাসের তুলনায় ওমরাহ পালন অনেকগুণ বেড়ে যায়। এতে হজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো অর্থনৈতিকভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
রোজার মাসে সাধারণত রোজাদাররা একটু ভালো খাওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। বিশেষ করে আমিষ জাতীয় খাবারের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাছাড়া শবে কদর, ঈদের দিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান মাংস ছাড়া তো চলেই না। ঈদের দিন এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না- যেখানে মাংস রান্না হয়নি। এ জন্য রোজার মাসে অনেক পশুর প্রয়োজন হয়ে পড়ে- যা পশু পালনে উৎসাহ বাড়ে। এতে আমাদের অর্থনীতির গতি বেড়ে যায়। এ ছাড়া ঈদের বন্ধে ভ্রমণে অর্থনৈতিক গতি কিছুটা বাড়ে। ধর্মীয় প্রকাশনাগুলোর ব্যস্ততা বেড়ে যায় ও অর্থনৈতিক সচলতা বৃদ্ধি পায়। সেলুন ও বিউটি পার্লারের ব্যবসাটি উজ্জীবিত হয় এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়ে। জামাকাপড় সেলাই করার জন্য রোজার ঈদকে উপযুক্ত সময় মনে করা হয়। শিশুরা এই সময় নতুন জামা পরে ঈদ উৎসব পালন করে। নতুন জামা না হলে তাদের ঈদই হয় না। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করেও তাদের কাজ শেষ হতে চায় না। এ জন্য রোজার সময় সূচি কর্মজীবীদের (দর্জি) ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তা অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। সুগন্ধি ও কসমেটিকশিল্পের প্রসার ঘটনায় এবং অনলাইন ব্যবসায় গতি বাড়ে। ফলে অর্থনীতির গতি বাড়ে। রোজার শেষের দিকে নাড়ির টানে সবাই যান নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি। তাই রেল, বাস, লঞ্চের যাত্রী অনেক গুণ বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এতে অর্থনীতির ঊধ্বগতি হয়।