মো. আবদুল মজিদ মোল্লা: পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে তার শিক্ষা কার্যক্রমে নারীদের ভূমিকা ও অবদানের উল্লেখযোগ্য কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও সেখানে পাঠদানের মাধ্যমে জ্ঞানের বিস্তৃতিতে নারীর ভূমিকা খুবই গৌণ। ইসলামি সভ্যতা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ইসলামি সভ্যতার সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত জ্ঞানের জগতে নারীর বিচরণ ছিল অবাধ।
মহানবি (সা.)-এর স্ত্রী হযরত মা আয়েশা (রা.) ছিলেন এ ধারার সফল ব্যক্তিত্ব। মহানবি (সা.)-এর ওফাতের পর যিনি ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন এবং নিজের ঘরকে বিদ্যাপীঠে রূপান্তরিত করেন। হযরত আয়েশা (রা.)-এর পর অসংখ্য মুসলিম নারী জ্ঞানের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। তবে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত তাদের শিক্ষা কার্যক্রম ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কেননা মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা কার্যক্রম স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করতে পেরিয়ে যায় প্রায় সাড়ে চার শ বছর।
৪৫৯ হিজরিতে ইসলামের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বছর মনে করা হয়। কেননা এ বছর সেলজুক প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলক তুসির মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষা সুসংহত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করে, যা অল্পদিনেই মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বহু শাসক ও ধনাঢ্য ব্যক্তি স্বতন্ত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। পুরুষের পাশাপাশি মুসলিম নারীরাও মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন।
শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানে নারীরা অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল তাদের শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের কারণে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক অ্যাগনেস মুরিয়েল ক্লে বলেন, ‘মুসলিম নারীরা পুরুষদের জাতীয় রাজনীতি, ক্ষমতাচর্চা, গঠনমূলক কাজ ও জীবনের নানা ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করত।’
দামেস্কে নারীদের ১৯ মাদরাসা
দামেস্ক ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জৌলুসপূর্ণ ও আলোকদীপ্ত শহর। ক্ষমতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতা সবদিক থেকেই তা ছিল মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। দামেস্কে বহু নারী পণ্ডিত, ফকিহ, হাদিসবিশারদ ও কবির আগমন ঘটে।
নারীরা এখানে একাধিক মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু ৫২৬ থেকে ৬৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নারীরা সেখানে ১৯টি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যথা- ১. মাদরাসাতুল খাতুনিয়্যা বারানিয়্যা, ২. মাদরাসাতুল খাতুনিয়্যা জাওয়ানিয়্যা, ৩. মাদরাসাতুল কুতবিয়্যা, ৪. মাদরাসাতুশ শামিয়্যা বারানিয়্যা, ৫. আল মাদরাসাতুল আজরাবিয়্যা, ৬. আল মাদরাসাতুল মারিদিনিয়্যা, ৭. আল মাদরাসাতুল ফররুখ শাহিয়্যা, ৮. আল মাদরাসাতুশ শামিয়্যা আল জাওয়ানিয়্যা, ৯. মাদরাসাতুস সাহিবাহ, ১০. আল মাদরাসাতুল মাইতুরিয়্যা, ১১. আল মাদরাসাতুল কামিলিয়্যা, ১২. আল মাদরাসাতুদ দিমাগিয়্যা, ১৩. আল মাদরাসাতুল আতাবিকিয়্যা, ১৪. মাদরাসাতুল আলিমা, ১৫. আল মাদরাসাতুল হাফিজিয়্যা, ১৬. আল মাদরাসাতুল মুরশিদিয়্যা, ১৭. আল মাদরাসাতুল আদিলিয়্যা আস-সুগরা, ১৮. আল মাদরাসাতুশ শোমানিয়্যা, ১৯. আল মাদরাসাতুল জামালিয়্যা। এছাড়া নারীরা আশ্রয়কেন্দ্র, আশ্রম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন।
হালবে নারীদের পদচিহ্ন
হালব ইরাকের একটি প্রাচীন নগরী। ইসলামি শাসনামলে এটি ছিল অত্র অঞ্চলের অন্যতম প্রধান জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ইসলামের সোনালি অধ্যায়ে হালবে ২ শতাধিক মাদরাসা, খানকা, রিবাত (সুফিধারার আবাসিক বিদ্যালয়) ও ঝাবিয়্যা (অস্থায়ী জ্ঞানের মজলিস) প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকটিই ছিল নারীদের প্রতিষ্ঠিত। যেমন আল ফিরদাউস কমপ্লেক্স। যার অধীনে একটি মাদরাসা, একটি মসজিদ, একটি রিবাত, একটি ঝাবিয়্যা, একটি তুরবা (যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের প্রায়োগিক ব্যবহার শেখানো হতো) ছিল। কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান জাহির গাজি বিন সালাহুদ্দিনের স্ত্রী রানি দাইফা খাতুন। আল মাদরাসাতুল কামিলিয়্যা হালবে নারীদের প্রতিষ্ঠিত আরেকটি বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান কামিলের কন্যা এবং সুলতান আজিজ মুহাম্মদের স্ত্রী ফাতিমা খাতুন। রহমা কাজিন বিনতে আবদুল কাদির প্রতিষ্ঠা করেন আল মাদরাসাতুর রহিমিয়্যা।
বাঙালি নারীর অর্থায়নে মক্কায় মাদরাসা
মক্কায় নারীরা একাধিক মাদারাসা, খানকা, রিবাত ও ঝাবিয়্যা প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার কয়েকটি হলো : খলিফা নাসির আব্বাসির মায়ের প্রতিষ্ঠিত রিবাত, মক্কার বিচারক শিহাবুদ্দিন তাবারির কন্যার প্রতিষ্ঠিত রিবাত, হিজরি ৮ম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত উম্মুল কুতুব কুস্তুলানির রিবাত, ৯৪০ হিজরিতে প্রতিষ্ঠিত উসমানীয় আমলের হুররম সুলতান প্রতিষ্ঠিত ‘রিবাতে খাসেকি সুলতান’। ১২৯১ হিজরিতে প্রতিষ্ঠিত হয় আল মাদরাসাতুস সাওলাতিয়্যা। কলকাতার বাঙালি নারী সাওলাতুন্নিসা বেগমের অর্থায়নে ভারতের বিখ্যাত আলেম রহমতুল্লাহ কিরানবি (রহ.) মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। যার শিক্ষা কার্যক্রম এখনো চলমান।
নারীর অর্থায়নে পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়
ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ আল ফিহরি মরক্কোর ফেজ শহরে প্রতিষ্ঠা করেন পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় কারাউইন, যা একটি মসজিদের আঙিনায় শুরু হয়েছিল। ফাতেমা আল ফিহরি জ্ঞানের সেবায় বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এখনো চলমান।
অন্যান্য অঞ্চলের কয়েকটি মাদরাসা
১. মার্ভ: মধ্য এশিয়ার মার্ভ শহরে ‘আল মাদরাসাতুল খাতুনিয়্যা’ নামে একটি বড় মাদরাসা ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন আইয়ুবীয় বংশের একজন অভিজাত নারী।
২. ত্রিপোলি: আধুনিক লিবিয়ার ত্রিপোলিতে দামেস্কের প্রশাসক ইজ্জুদ্দিনের স্ত্রী আরগুন খাতুন ‘আল মাদরাসাতুল খাতুনিয়্যা’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. ফিলিস্তিন: ফিলিস্তিনে নারীদের প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য মাদরাসা হলো ‘আল মাদরাসাতুল বারুদিয়্যা’, ‘আল মাদরাসাতুল উসমানিয়্যা’ ও ‘আল মাদরাসাতুল খাতুনিয়্যা’।
৪. দিল্লি ও ভুপাল: ভারতবর্ষে ভুপালের রাণী শাহজাহান বেগম একাধিক মাদরাসা, মসজিদ ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতানা রাজিয়া দিল্লি ও তাঁর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শতাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
৫. ইয়েমেন: প্রাচীনকালে ইয়েমেনে নারীদের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার সংখ্যা ৩৩টি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো সালেহিয়্যা, সাবেকিয়্যা, শাসসিয়্যা, মু’তাবিয়্যা, ইয়াকুতিয়্যা, নাজমিয়্যা, জাহরিয়্যা, হাদারিয়্যা, আয়েশিয়্যা, ওয়াসিকিয়্যা ইত্যাদি।
৬. মিসর: মিসরেও নারীরা শিক্ষা ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় অবদান রাখে। তারা অসংখ্য মাদরাসা, খানকা, ঝাবিয়্যা ও রিবাত প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রত্যেকটিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হতো। মিসরে নারীদের প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি মাদরাসা হলো কুতবিয়্যা, হিজাজিয়্যা, আশুরিয়্যা, আস-সগিরা আস-সুন্নিয়্যা, আন-নাহদা, বানাতুল আশরাফ ও আল ইহসান।