ড. মোবারক হোসেন: মহান রাব্বুল আলামিন অপরূপ সৌন্দর্যে বিভূষিত করে অগণিত সৃষ্টিরাজির চারণভূমি এ বিশ্বভুবন সৃজন করেছেন। মহান মালিক আসমান জমিন দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে যা কিছু আছে সকল সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা, লালনকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা, জীবন ও মৃত্যুদাতা। মহান প্রভুর সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষকে শান্তি ও মুক্তির সন্ধান দেওয়ার জন্য মহান প্রভু এই পৃথিবীতে অসংখ্য শিক্ষক প্রেরণ করেছেন। সৃষ্টির আদি থেকে নবুয়তের যুগে নবি-রাসুলগণ ও বেলায়েতের যুগে আউলিয়ায়ে কেরাম মানুষকে আলোকিত এবং আদর্শ ও চরিত্রবান মানুষ বানানোর জন্য এ পৃথিবীতে আগমন করেন।
মানুষ সামাজিক জীব। একে অন্যকে সাহায্য সহযোগিতা করার মাধ্যমে প্রাপ্ত সুবিধার কথা চিন্তা করে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। ব্যক্তিবিহনে সমাজের কোনো অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, সেজন্য সৎ ও শান্তিকামী ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি সৎ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে উঠে। অসৎ ও স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তির কারণে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। তাই সমাজ ও দেশকে শুদ্ধির প্রশ্নে ব্যক্তি শুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যুগে যুগে মহান রাব্বুল আলামিন অশুদ্ধ আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে মানুষকে পরিবর্তনের জন্য তার প্রিয় বন্ধুদেরকে পাঠিয়েছেন। তারা এসে মানুষকে পরিশুদ্ধ এবং সমাজ পরিবর্তনের সুমহান শিক্ষা দিয়েছেন। ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। স্রষ্টার প্রতি বিনীতভাবে অনুগত হয়ে অর্থাৎ আল্লাহ্তে আত্মসমর্পণ করে সৃষ্টির সাথে একাত্মতা স্থাপন করার নামই ইসলাম। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার জন্য পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা আইনগত ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজন হয় না। মানুষ নফস তথা জীবাত্মার তাড়নায় পরিচালিত না হয়ে আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে নিজেকে পরিচালিত করে তাহলে মানুষ শান্তি লাভ করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেনÑ“হে যারা ইমান এনেছ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ২০৮)
সৃষ্টির আদি থেকে মহিমান্বিত আল্লাহ্ অসংখ্য নবি-রাসুল অলী-আল্লাহ্ প্রেরণ করেছেন। এই সকল মহামানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ইসলামের মর্ম বাণী শান্তির বিধান প্রচার করেন, মানুষের অন্তরে শান্তি পৌঁছে দিয়ে ইসলাম বাস্তবিকই শান্তির ধর্ম তা উপলব্ধি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। অন্ধকার রাতে যে ব্যক্তির কাছে জ্বালানো বাতি রয়েছে তার কাছে গেলে যেমন আলো পাওয়া যায়, তেমনি পথভ্রষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং ষড়রিপুর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে অশান্তির পথ চলে। মানুষ যখন শান্তির দূত মহামানবের সহবত লাভ করে। তখন মানুষ শান্তির সন্ধান লাভ করে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেনÑ “হে রাসুল! বলুন সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্রই, আর শান্তিতো বর্ষিত হয় তাঁর ঐ বান্দাদের উপর, যাঁদেরকে তিনি মনোনীত করেছেন।” (সূরা আন নামল ২৭: আয়াত ৫৯)
মানুষ যখন আল্লাহ্র মনোনীত মহামানবের দেওয়া বিধান অনুসরণ করে ষড়রিপুর শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হয়ে অতঃপর সকল অন্যায় কর্ম থেকে বিরত থাকে, সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্র পরিচয় লাভ করে এবং তাঁর উপর পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নিজেকে সর্বোত্তম পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়। তখন মানুষের হৃদয়ে আল্লাহ্র প্রেম জাগ্রত হয় ও অন্তর আলোকিত হয়। শুদ্ধ মানুষ হয়ে সমাজে বসবাস করতে পারে। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে- মূলত এটিই ইসলাম। যে মত ও পথ অনুসরণ করলে মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে সক্ষম এবং অন্যকে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ করে দেয় প্রকৃতপক্ষে ইহাকে ইসলাম বলা হয়। মুসলিম শব্দের অর্থ শান্তিতে বসবাসকারী বা আত্মসমর্পণকারী। যিনি আল্লাহ্র উপর আত্মসমর্পণ করতে সক্ষম হয়েছে তাকে মুসলমান বলা হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন – “মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্কে যথার্থরূপে ভয় করো এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে কোনো অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করোনা।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ১০২) প্রকৃত মুসলমান ঐ ব্যক্তি যে নিজে শান্তিতে বসবাস করে এবং অপরকে শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ করে দেয়। একজন আদর্শবান মানুষ কখনো অন্য কারো অশান্তির কারণ হয় না। এ প্রসঙ্গে মহান সংস্কারক মোহাম্মদী ইসলামের পুনর্জীবনদানকারী সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেনÑ“সমাজ ব্যক্তিকে শুদ্ধ করতে পারে না, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তি শুদ্ধ হয়, আর ব্যক্তিশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজ শুদ্ধ হয়।” মানুষকে পরিশুদ্ধ পরিবর্তন সংশোধন করার লক্ষ্যে মহান রাব্বুল আলামিন দয়া করে তাঁর প্রিয় বন্ধুদেরকে এ জগতে পাঠিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর বলেনÑ “সৃষ্টির সাথে আপনি যেরূপ, স্রষ্টা আপনার সাথে সেরূপ, আপনি সৃষ্টির প্রতি ক্ষমাশীল হোন, স্রষ্টা আপনার প্রতি ক্ষমাশীল হবেন।”
মহান প্রভুর সাথে একত্ববাদ অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করার নামই ইমান। আল্লাহ্র প্রেরিত নবি-রাসুল ও আউলিয়ায়ে কেরামের শিক্ষানুযায়ী আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকে ইমান বলা হয়। ইমান একটি নুর বিশেষ। এই নুর নবি-রাসুল আউলিয়ায়ে কেরামের সিনায় সংরক্ষিত থাকে। নবি-রাসুলগণের যুগ শেষ হওয়ার পর, বেলায়েতের যুগে যে ব্যক্তি আল্লাহ্র বন্ধুদের সান্নিধ্যে গিয়ে সাধনার মাধ্যমে ইমানের নুর নিজের ক্বালবে প্রজ্বলিত করতে সক্ষম হয়েছে, সে ব্যক্তিই সফল হয়েছে। তিনিই সমাজ রাষ্ট্রের আদর্শ মানুষ হিসেবে পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম। ইসলামকে জীবন বিধানও বলা হয়। মোহাম্মদী ইসলামের আদর্শ এবং মুসলমানদের উত্তম চরিত্র দেখে পূর্ব যুগের বিধর্মীরাও এর সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে ধন্য হয়েছে। কালক্রমে মুসলমানগণ মোহাম্মদী ইসলামের সেই আদর্শ ও ঐতিহ্য হারিয়ে আজ মনিহারা সাপের ন্যায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। মু’মিন ব্যক্তিদের সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) বলেন “মু’মিন মহান আল্লাহ্র নিকট কিছু সংখ্যক ফেরেশতার চেয়েও অধিক মর্যাদাবান। (ইবনে মাজাহ শরীফ, পৃষ্ঠা ২৮৩) যে ব্যক্তি ষড়রিপুর বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে আল্লাহ্র পরিচয় লাভে ব্যর্থ, সে নিকৃষ্ট প্রাণীতুল্য। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন- “আর আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য এমন অনেক জিন ও মানুষ, যাদের অন্তর আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা বোঝে না, তাদের অন্তরে চোখ আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না এবং তাদের অন্তরে কান আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা সত্যবাণী শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তার (সেগুলোর) চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই গাফেল-উদাসীন। (সূরা আ’রাফ ৭: আয়াত ১৭৯)
মহান রাব্বুল আলামিন মানুষকে ফেরেশতার চেয়েও বেশি মর্যাদাবান করেছেন, আবার খারাপ চরিত্রের কারণে সে মানুষই পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে যায়। মহান রাব্বুল আলামিন মানুষকে প্রতিনিধি করে জগতে প্রেরণ করেছেন। মানুষ পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক কারণে ষড়রিপুর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে প্রতিনিধিত্বের গুণ হারিয়ে ফেলেছে। তখনই আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেনÑ“আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি অতিশয় সুন্দর গঠনে। অতঃপর আমি তাকে ফিরিয়ে দেই হীন থেকে হীনতম অবস্থায়। (সূরা আত তীন ৯৫: আয়াত ৪ ও ৫)
এ প্রসঙ্গে মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান বলেন- “আত্মশুদ্ধি না হলে তার দেহ শুদ্ধ হয় না, আর দেহ শুদ্ধ না হলে কোনো ইবাদত সহিশুদ্ধভাবে করা সম্ভব নয়। আত্মশুদ্ধি না থাকলে ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা থাকে না। সেই ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে কোনো অপরাধ করতে তার মনে কোনো দ্বিধাবোধ হয় না।” এ প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) বলেনÑ “শয়তান আদম সন্তানের ক্বালবে বা দিলের মাঝে অবস্থান করে, যখন সে আল্লাহ্র জিকির করে, শয়তান তখন সরে যায়। আর যখন সে (আল্লাহ্র) জিকির থেকে গাফেল হয়, তখন তার দিলে শয়তান ওসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দিতে থাকে।” (বোখারী শরীফের সূত্রে মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা ১৯৯) অন্য এক হাদিসে হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “যখন মানুষের ক্বালব ভালো অর্থাৎ পরিশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন তার গোটা শরীর পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর যখন মানুষের ক্বালব খারাপ তথা দুষ্কর্মময় হয়ে পড়ে, তখন পুরো মানুষটিই খারাপ হয়ে যায়।” (তাফসীরে মিজান ১৫নং খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৮)
মানুষের ক্বালবকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ্ দয়া করে তাঁর বন্ধুদের পাঠিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন- “যেদিন ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোনো কাজে আসবে না। সে দিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহ্র নিকট আসবে ক্বালবে সালিম তখা বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে।” (সূরা আশ শু‘আরা ২৬: আয়াত ৮৮ ও ৮৯) মানুষের কুরিপুসমূহ দমন করতে আল্লাহ্ময় জগতের উপাদানসমূহকে সজীব ও শক্তিশালী করে মানুষকে শান্তি ও মুক্তি লাভের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। শান্তি ও মুক্তি মানুষের আত্মার উন্নতি লাভ করতে হলে মহান রাব্বুল আলামিনের প্রেরিত মহামানবগণের অনুসরণ করতে হয়। তাঁদের দেখানো পথে পরিচালিত হয়ে নিজেদেরকে আত্মশুদ্ধি লাভ করার জন্য সমকালীন যুগের মহামানবের সহবত লাভ করা একান্ত কর্তব্য। সমগ্র মানবজাতির মাঝে জ্ঞানীগুণী বিবেকবুদ্ধিতে ও চরিত্রে সমকালীন সময়ের সকল মানুষের চেয়ে উত্তম এবং আল্লাহ্র সর্বাধিক প্রিয় পাত্র হিসেবে পরিগণিত তিনিই যুগের ইমাম। সৃষ্টির আদিকাল থেকে আল্লাহ্ তায়ালা মানবজাতিকে হেদায়েত করার লক্ষ্যে তাঁর প্রিয় বন্ধুদের পাঠিয়েছেন।
যুগের ইমাম মানুষকে হেদায়েতের পবিত্র দায়িত্ব পালন করেন। যুগের ইমাম প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন- “আমি ইব্রাহিমকে দান করলাম পুত্র ইসহাক এবং আরও দান করলাম পৌত্র ইয়াকুব। আর তাদের প্রত্যেককেই করলাম সৎকর্মপরায়ণ। আমি তাঁদেরকে করেছিলাম নেতা (ইমাম), তাঁরা আমার আদেশ অনুসারে হিদায়াত করতেন। আমি তাঁদেরকে ওহির মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছিলাম- নেক কাজ করতে, নামাজের পাবন্দী করতে এবং যাকাত প্রদান করতে এবং তাঁরা আমারই ইবাদত করতেন।” (সূরা আম্বিয়া ২১: আয়াত ৭২ ও ৭৩)
প্রত্যেক যুগেই হিদায়েতকারী মহামানব থাকেন, যারা মানুষকে হিদায়েতের পথপ্রদর্শন করেন। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন “আমি তো মুসাকে কিতাব দিয়েছি। অতএব আপনি তাঁর সাক্ষাত সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ করবেন না। আমি তাঁকে বনি ইসরাঈলের জন্য পথপ্রদর্শক করেছিলাম। আর আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা (ইমাম) মনোনীত করেছিলাম, যাঁরা আমার আদেশ অনুযায়ী হিদায়েত করতেন, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।” (সূরা আস সাজদাহ ৩২: আয়াত ২৩ ও ২৪)
যুগের ইমামগণের মাঝে নুরে মোহাম্মদী বিরাজিত থাকে তাদের অনুসরণ করলে কুল কায়েনাতের রহমত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দিদার লাভ করা সম্ভব হয়। মহান রাব্বুল আলামিনের রহমতের ছায়ার নিচে থেকে পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে মহান মালিকের দিকে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হয়। যুগের ইমামগণের ফায়েজের দ্বারা সমগ্র জগত পরিচালিত হয়। যুগের ইমাম প্রসঙ্গে হযরত রাসুল (সা.) বলেনÑ “যে ব্যক্তি তার জামানার ইমামকে চিনতে পারে না এবং এ অবস্থায় যদি মৃত্যু ঘটে তবে তার মৃত্যু অন্ধকারে নিমজ্জিত ও নিপাতিত হবে।” (মুসনাদে ইমাম সাদেক ২য় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৫১৯ ও ৫৩৩)
যিনি নুরে মোহাম্মদীর ধারক-বাহক তিনি সমকালীন সময়ের ইমাম। যুগের ইমামের পরিচয় লাভ করে তার আনুগত্য স্বীকার করা সকল মুক্তিকামী মানুষের একান্ত কর্তব্য। মহান রাব্বুল আলামিনের আপন পরিচয় প্রকাশের উদ্দেশ্যে জগত সৃষ্টি করে প্রত্যেক যুগে তার মনোনীত নবি-রাসুল, অলী-আল্লাহ্ প্রেরণ করে তাঁর গুণ- বৈশিষ্ট্য বিকশিত করেছেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে রাব্বুল আলামিনের সকল গুণ প্রকাশিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন- “হে রাসুল! নিশ্চয় যারা আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে, তারা তো আল্লাহ্রই হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। আল্লাহ্র হাত তাদের হাতের উপর। (সূরা আল ফাতহ ৪৮: আয়াত ১০)
ইমাম আরবি শব্দ। বাংলা অর্থ নেতা, প্রধান দিকনির্দেশক। যেমন- মাজহাবের ইমাম, তরিকার ইমাম। মহান রাব্বুল আলামিন এ বিশ্বজগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। যুগ পরিক্রমায় মহান রাব্বুল আলামিন মহামানব প্রেরণ করে আসছেন। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এসকল মহামানবদেরকে নবি-রাসুল, মোজাদ্দেদ, যুগের ইমাম ও অলী-আল্লাহ্ বলা হয়। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এবং সর্বশেষ নবি ও রাসুল হলেন কুল-কায়েনাতের রহমত, সকল নবি ও রাসুলের ইমাম হযরত মোহাম্মদ (সা.)। নবুয়তের যুগে মহান আল্লাহ্ যে সকল নবি ও রাসুলকে প্রেরণ করেছেন, ওহির বাণী আল-কুরআনে এ সকল মহামানবকে ‘ইমাম’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁরা সবাই ছিল সমকালীন যুগের ধর্মীয় নেতা বা ইমামরূপে দায়িত্ব পালন করেছে। মুসলমান জাতির আদি পিতা হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আ.) প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন- “এবং স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি কথা দিয়ে পরীক্ষা করলেন, তারপর সে তা পূর্ণ করল; তখন আল্লাহ্ কললেন: আমি তোমাকে মানবজাতির ইমাম বানাবো। সে বলল: আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও? আল্লাহ্ বলেন: আমার প্রতিশ্রæতি জালিমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়।” (সূরা বাকারা ২: আয়াত ১২৪)
হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) বলেনÑ “যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে, কিন্তু সে তার যুগের ইমামের পরিচয় লাভ করতে পারেনি, সে জাহেলি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।” (মুসনাদে ইমাম সাদেক ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১৮ ও ৫১৯) নবুয়ত পরবর্তী বেলায়েতের যুগেও আউলিয়ায়ে কেরামের বংশপরম্পরা হযরত রাসুল (সা.)-এর রেখে যাওয়া ধর্ম পরিচালিত হয়েছে। আমাদের মহান মোর্শেদ কেব্লাজান ছিলেন সমকালীন যুগের ইমাম।
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেব্লাজান নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন হযরত রাসুল (সা.)-কে। তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে আল্লাহ্ এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম মোহাম্মদী ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য। তিনি কখনো কারও রক্তচোখকে ভয় করে নাই। তিনি ধর্মের অসংখ্য ভুল সংশোধন করে মোহাম্মদী ইসলামকে সঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছেন। এ মহামানবের মূল শিক্ষা ছিল মানুষকে পরিশুদ্ধ করা। তাঁর অসংখ্য বাণী মোবারকে বলেছেন চরিত্রবান হয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধণ করা। তিনি আরো বলেছেন, অসৎলোক বা অশুদ্ধ আত্মার মানুষ কোনো মানুষের উপকার করতে পারে না। সে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত মানুষকে শান্তি, মুক্তি ও মানবতার সুমহান শিক্ষা দিয়েছেন। সঠিকভাবে নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত-সহ ইসলামের সকল ইবাদত কীভাবে পালন করলে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করা যায় সেই শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ্র মহান বন্ধুর এই শিক্ষা এখনো চলমান। তিনি বলেছেন কিয়ামত পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে। তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে যাওয়ার পূর্বেই অছিয়তের মাধ্যমে তাঁর প্রাণপ্রিয় মেজো সাহেবজাদা ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.)-কে মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারীর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। ইমাম প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর ১৯৮৫ সালের ‘লাইলাতুল ক্বদর’ রজনিতে শুভাগমন করেন। তাঁর সম্মানিত পিতা আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহ্বুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) এবং তাঁর সম্মানিত মহীয়সী মাতা কুতুবুল আকতাব সৈয়দা হামিদা বেগম (রহ.)। প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) বর্তমানে মোহাম্মদী ইসলামের নেতৃত্ব প্রদানকারী মহামানব। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে সারাবিশ্বে মোহাম্মদী ইসলামের নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। তাঁর পবিত্র মুখের বাণী মোবারক শুনে পথহারা মানুষ আবার নতুন করে জীবনের পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। তিনি মানুষের ত্রাণকর্তা ও শান্তিদাতা হিসেবে শুভাগমন করেছেন।
প্রফেসর ড. কুদরত এ খোদা (মা. আ.) হুজুর হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ এবং মানবতার মহান শিক্ষক হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সান্নিধ্যে এসে অসংখ্য মানুষ নিজেদেরকে পরিবর্তন করার সুমহান শিক্ষা গ্রহণ করে মানবজীবনকে ধন্য করেছে। তিনি শুধু আল্লাহ্র বন্ধু নন, তিনি হলেন মানুষ গড়ার সুমহান কারিগর, তাঁর আর্দশ ছড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে। আল্লাহ্র এ মহান বন্ধুর শুভ জন্মদিন পবিত্র লাইলাতুল ক্বদরে, হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ মাসে। আমরা গোলাম পাপী-তাপী মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির দিন পবিত্র লাইলাতুল ক্বদর রজনি।
পরিশেষে, মহান প্রভুর নিকট প্রার্থনা আমরা যে তাঁর প্রিয় বন্ধুর শুভ জন্মদিনে খুশি হয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারি এবং বাকী জীবন গোলামি করে তাঁর কদম মোবারকে থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি, এই প্রার্থনা মহান প্রভুর দরবারে। আমিন।