নারী ডেস্ক: শেরপুর খামারকান্দি ইউনিয়নের বাসিন্দা রওশন আরা ও নবী মিয়ার ঘরে দুই কন্যা। সম্প্রতি তাদের বড় মেয়ে নূরীর বিয়ে দিয়েছেন। জানা যায়, একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তারা। মেয়ের মা রওশন আরা বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, মেয়েকে বেশি লেখাপড়া করালে, আমরা অতো শিক্ষিত পাত্র পাবো কই? আর আমাদের গ্রামে এ বয়সেই সব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে, বেশি লেখাপড়া করালে লোকে খারাপ বলে। বিয়ে দিয়েছি, এখন পাত্রপক্ষ যদি লেখাপড়া করায় তো পড়বে।’
ঢাকার সোনারগাঁওয়ের নোয়াগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা আছফিয়া বেগম ও মাসুম মিয়া। তাদের মেয়ে উর্মি, দশম শ্রেণিতে পড়েন। গ্রামের মেকানিক লিটনকে (২১) ভালোবেসে পালিয়ে তাকে বিয়ে করেন উর্মি। পরে দুই পরিবার বিয়ে মেনে নিলেও মেয়েটিকে আর লেখাপড়া করাবেন না তারা। কারণ হিসেবে ছেলের মা জানিয়েছেন, ‘এই বয়সে আমার ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে, আবার স্কুলে পাঠাবো, সেখানে অন্য ছেলের সঙ্গে যদি পালায়! এই কারণে মেয়েটিকে ঘরবন্দি রাখা হলো। বন্ধ হলো মেয়েটির লেখাপড়া।’
জানা যায়, নূরী ও উর্মি- দুই মেয়েই লেখাপড়ায় ভালো ছিল। তবে তাদের পরিবারের কাছে মেয়েদের বিয়েই মুখ্য। সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় জানা গেছে-বাংলাদেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি পরিবারে বাল্যবিবাহের চর্চা হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে এসব পরিবারের যেসব মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা পুত্রবধূ হিসেবে যারা এসেছে, তাদের ৬০ শতাংশেরও বেশি মেয়ের বয়স বিয়ের সময় ১৮ বছরের কম ছিল। এছাড়া ৫৬ শতাংশ বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের মাধ্যমিক পাশ করার আগেই বিয়ে হয়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
‘বর্ন টু বি আ ব্রাইড’ বা ‘কনে হওয়ার জন্যই জন্ম’-এই শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ব্র্যাকের সোশ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল প্রোটেকশন (সেলপ) কর্মসূচি। বাল্যবিবাহের প্রবণতা ও কারণ জানতে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি ২৭টি জেলায় এই জরিপ চালিয়েছে। জরিপের তথ্য বলছে, এসব জেলায় ৪৪.৭ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগেই বাল্যবিবাহের শিকার হয়। গবেষণায় দেখা যায়, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের ৬.৯ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পিরোজপুর, সেখানে বাল্যবিবাহের হার ৭২.৬ শতাংশ। বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে কম নেত্রকোনায়-২৪.১ শতাংশ। বাল্যবিবাহের শীর্ষে থাকা অন্য জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ (৬৫.২ শতাংশ), নওগাঁ (৬৫.২ শতাংশ), ঠাকুরগাঁও (৬২.৫ শতাংশ) এবং জয়পুরহাট (৬১.৪ শতাংশ)। এছাড়া যোগ্য পাত্র পাওয়ার কারণে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন ৪৪ শতাংশ অভিভাবক। বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে ১৮ শতাংশ দারিদ্র্য, যৌতুক কম বা না চাওয়ার কারণে ১০ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তার অভাবের কথা বলছেন ৭ শতাংশ, পড়ালেখায় ভালো না হওয়ার কারণে ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণের কথা বলেছেন ১৫ শতাংশ।
বাল্যবিবাহের এই হার কেবল বেসরকারি জরিপেই নয়, সরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনেও বাল্যবিবাহের এমন তথ্য মেলে। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাল্যবিবাহের হারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম এবং এশিয়ায় প্রথম। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ে বা বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করার দ্বারপ্রান্তে চলে আসা মেয়েরা সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। ১৬-১৭ বছর বয়সি মেয়েদের বিয়ের হার ৬৩ শতাংশের বেশি। স্কুল থেকে ঝরে পড়া মেয়েদের চেয়ে পড়াশোনায় থাকা অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয়েছে—এ হার ৫৬ শতাংশ। বাকি ৪৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ হওয়া মেয়েদের কেউ ছয় মাস, কেউ এক থেকে সাত বছরের বেশি সময় স্কুলে পড়েছে, আবার কেউ কখনোই স্কুলে পড়েনি। এ প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশু বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারপারসন মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, বাল্যবিবাহ নিয়ে যেসব গবেষণা হয়, সবখানেই একই ধরনের স্টাডি দেখা যায়। যেসব ছেলে অল্পবয়সি মেয়েদের বিয়ে করছে তাদের নিয়ে কোনো গবেষণা হচ্ছে না। যারা অল্পবয়সি মেয়ে বিয়ে করছে সেসব ছেলের ছবি তুলে পত্রিকায় প্রকাশ করা দরকার। বিদেশে থাকা ছেলেরা দেশে এলেই বিয়ের জন্য অল্পবয়সি মেয়ে খোঁজে। তিনি বলেন, অল্পবয়সি কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে প্রথমে ভালো লাগবে, কিন্তু কিছুদিন পর বউকে পছন্দ হবে না। কারণ অনেক দিক দিয়ে অনভিজ্ঞ থাকবে ঐ কমবয়সি মেয়ে। শিক্ষায়, চিন্তায় ওর বয়স থাকবে ছোট।
তিনি আরো বলেন, স্কুলে বিনা মূল্যের বই দেওয়া হচ্ছে বলে মেয়েদের সংখ্যা স্কুল পর্যন্তই বেশি। তাদের উচ্চশিক্ষায় বাবা মা আর পাঠান না। মহিলা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সালেহা বিনতে সিরাজ বলেন, আমাদের এসডিজির প্রধান অন্তরায় বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য সরকার বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে, যেন বাল্যবিবাহটা না হয়। যে ঘরে কিশোরী মেয়ে আছে, আমরা সেই কিশোরীর মাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি, তাকে চাল দেওয়া হয় এই শর্তে যে, তাদের খাদ্যের নিরাপত্তা আছে, মেয়েটারও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কিশোর কিশোরী ক্লাব আছে, এছাড়া আরো নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবুও বাল্যবিবাহ ঠেকানো যাচ্ছে না।