মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
মহানবি (সা.)-এর সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, বিশ্বস্ততায় তিনি হয়ে ওঠেন ‘আল-আমিন’, তিনি বিশ্ববাসীর জন্য ‘খাতামুন্নাবিয়্যিন’ এবং সর্বকালের জন্য ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উচ্চারণ:
‘মানুষে মানুষের অধিকার দিল যে-জন
এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই’ কহিল যে-জন,
এলো ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী
ব্যথিত-মানবের ধ্যানের ছবি
আজি মাতিল বিশ্ব-নিখিল মুক্তি-কলোরোলে।’
সব কাল, সব দেশ, সব মানুষের জন্য সব সময়ের সেরা ও পরিপূর্ণ আদর্শ মহামানব মুহাম্মদ (সা.)। বিশ্বনবির (সা.) দর্শন ও তৎপরতা বিশ্বজনীন।
নিছক ধর্ম প্রচারকের বৃত্তে নয়, বরং তার বাইরেও প্রিয় নবি (সা.) একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, ন্যায়পরায়ণ বিচারক, কল্যাণকামী নন্দিত শাসক এবং আন্তর্জাতিক ঐক্যের প্রতিভূ ও একজন দক্ষ কূটনীতিক। ধর্মের বিজয় ও প্রতিষ্ঠার জন্য জাগতিকতার সব অনুষঙ্গকে তিনি ব্যবহার করেছেন মহান আল্লাহর আদেশ ও অভিপ্রায়ের অংশ হিসেবে।
প্রিয় নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের মাহাত্ম্য এমন যে তিনিই পৃথিবীর একমাত্র অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, যাঁর নাম গর্ব-শ্রদ্ধায় নিজের নামের সূচনায় মানুষ লেখে ‘মুহাম্মদ’ এবং নিজেকে ‘উম্মতে মুহম্মদি’ হিসেবে পরিচয় দেয়। পবিত্র কোরআনের একটি সুরার নাম ‘মুহাম্মদ’। আল-কোরআনে ‘মুহাম্মদ’ শব্দটি চারবার, ‘আহমদ’ শব্দটি একবার উল্লেখসহ ২৯টি গুণবাচক নামের বর্ণনায় ২২৪ বার তাঁর (সা.) আলোচনা আছে। প্রিয় নবি (সা.) হলেন ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আপনার আলোচনাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছি। ’ (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত ২)
কবি গোলাম মোস্তফার ভক্তিময় উচ্চারণ:
‘তুমি যে নুরের রবি নিখিলে ধ্যানের ছবি
তুমি না এলে দুনিয়ায় আঁধারে ডুবিত সবই…।’
‘রবিউল আউয়াল’ অর্থ বসন্তের প্রারম্ভ। মরুর ঊষর-ধূসর প্রান্তরে নবির আগমন প্রতীক্ষায় প্রকৃতি সেজেছিল মায়াবী রূপসজ্জায়। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ, পাখ-পাখালির কূজন, নদীর কলতান, বাতাসের উদাসী গুঞ্জরণ শোনায় বিশ্বনবীর আগমনী বার্তা। আজও কান পাতলে বাংলার ঘরে ঘরে শোনা যায়:
‘আজকে যত পাপী ও তাপী
সব গুনাহের পেল মাফী
দুনিয়া হতে বে-ইনসাফী
জুলুম নিল বিদায়…। ’
(কাজী নজরুল ইসলাম)।
মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক, সফল ও শ্রেষ্ঠতম সংস্কারক। এখানেই আল-কোরআনের বাণীর নিত্যতা: ‘তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন, এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ।’ (সুরা আলে ইমরান: আয়াত : ১০৩)
বিশ্বনবি (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় এবং তাঁর আগে বিশ্বের সর্বত্র চলছিল ধর্মীয় বিশ্বাস ও সমাজের সর্বত্র ছিল করুণ হাহাকার। এ ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর সংস্কারমূলক কাজের কিছু দিক তুলে ধরছি : ১. একত্ববাদের প্রতিষ্ঠা, ২. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণ, ৩. পৌত্তলিকতার অবসান, ৩. ভ্রান্ত বিশ্বাসের পরিবর্তন, ৪. যাজকতন্ত্রের অবসান, ৫. জন্মান্তরবাদ, ৬. পুনর্জন্মবাদের চেতনার অবসান, ৭. পারলৌকিক জীবনে বিশ্বাস, ৮. সকল নবী-রাসুলের প্রতি বিশ্বাস, ৯. আল্লাহর ইবাদত, ১০. ইসলামী শরিয়তের শিক্ষা, ১১. নামাজের শিক্ষা, ১২. রোজার শিক্ষা, ১৩. হজের শিক্ষা, ১৪. জাকাতের শিক্ষা, ১৫. দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক হানাহানির অবসান, ১৬. অনৈক্যের অবসান, ১৭. শ্রেণিবৈষম্যের অবসান, ১৮. বর্ণবাদ, দাসপ্রথা, চুরি, ব্যভিচার রহিতকরণ, ১৯. সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, মাদকাসক্তি, হত্যা, লুণ্ঠন ইত্যাদি অনাচার বিলোপ, ২০. নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, পর্দা প্রথা প্রচলন ও নারী-পুরুষের মর্যাদা নিশ্চিতকরণ, ২১. সব কথার শেষ কথা ইসলামই মানবতার মুক্তির মহাসনদ।
মানবতার নবি মুহাম্মদ (সা.) মানবজাতিকে শিক্ষা দিলেন, মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক, আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত জীবনের সব দিক ও বিভাগে ইসলামি দিকনির্দেশনা রয়েছে। এ জন্য প্রিয় নবি (সা.)-এর অবদান বিশ্বজনীন, তিনিই সবার আদর্শ ও প্রেরণা।
প্রিয় নবি (সা.)-এর প্রতি ভক্তিময় আবেগে বেশি বেশি ‘সিরাত’ বা তাঁর জীবনী নিয়ে চর্চা-গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তাঁকে (সা.) নিয়ে কটূক্তি ঈমানের পরিপন্থী এবং কাম্য নয়। কবির ভাষায় নিবেদন-
‘ওরা কাদা ছুড়ে বাধা দিবে ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ
মোরা ফুল ছুড়ে মারবো ওদের বলবো আল্লাহ জিন্দাবাদ। ’
(এক আল্লাহ জিন্দাবাদ: কাজী নজরুল ইসলাম)