দেওয়ানবাগ ডেস্ক: প্রতি বছর বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি ও বাজেট। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের কষ্ট কমাতে নানা রকম ভাতা চালু করেছে সরকার। ভিক্ষাবৃত্তির লজ্জা থেকে দেশকে মুক্ত করতে ২০১০ সালেই হাতে নেওয়া হয় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি। এতসব উদ্যোগের মধ্যেও বন্ধ হয়নি ভিক্ষাবৃত্তি। উল্টো দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানীর অলিগলি ভরে গেছে ভিক্ষুকে। প্রতিনিয়ত সড়কে ভিক্ষার ঝুলি হাতে অভাবী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষিত কূটনৈতিকপাড়ার ফুটপাতেও প্রতিদিন থালা হাতে বসছেন অনেকে।
ভিক্ষাবৃত্তির লজ্জা থেকে দেশকে মুক্ত করতে ২০১০ সালে সীমিত পরিসরে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করে সরকার। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে পরিসর বাড়িয়ে প্রথমবারের মতো দেশের ৫৮টি জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের নিমিত্তে ৩ কোটি টাকা প্রেরণ করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভিক্ষুক পুনর্বাসনে ব্যয় হয় প্রায় ২৭ কোটি টাকা। তবে কমছে না ভিক্ষুক। ঢাকা শহরে ভিক্ষাবৃত্তি রোধ ও দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য প্রাথমিকভাবে বিমানবন্দরে প্রবেশ পথের পূর্ব পাশের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর আশপাশ এলাকা, হোটেল রেডিসন সংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলি রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল রূপসী বাংলা সংলগ্ন এলাকা, রবীন্দ্র সরণি এবং কূটনৈতিক জোনকে ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা ঘোষণা করা হয়। অথচ, কানাডিয়ান হাইকমিশনের পাশে লেকপাড়ে প্রতিদিনই দেখা মেলে অন্তত ডজনখানেক ভিক্ষুকের। গতকাল কানাডিয়ান হাইকমিশনের পাশে লেকপাড়ে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ভিক্ষা করছিলেন সত্তরোর্ধ্ব শিনু গাজী (ছদ্মনাম)। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘আমার আত্মীয়-স্বজন সরকারের বড় বড় দায়িত্বে কর্মরত। আমি ভিক্ষা করছি জানলে তাদের সম্মান ক্ষুণœ হবে।’ ভিক্ষার কারণ জানাতে গিয়ে বলেন, ‘স্বামী মারা গেছেন ৩০ বছর আগে। গ্রামে বাবার অনেক জমিজমা ছিল। বাবার মৃত্যুর পর ভিটেবাড়ি পাইনি। চাচাত ভাইয়েরা একটা জমি দিয়েছে পানির মধ্যে। তা ভরাট করে ঘর তোলার সামর্থ্য আমার নেই। বিধবা ভাতা যা পাই, তাতে চালের খরচই ওঠে না। ঢাকায় এসে একটা সমিতি থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছিলাম। ছিনতাইকারী সেই টাকা নিয়ে গেছে। এখন ভিক্ষা করে খাই ও ঋণের কিস্তি দেই।’ একই স্থানে ভিক্ষা করতে দেখা যায় আরও ছয়-সাতজনকে। সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর ভিক্ষুকদের বড় একটি অংশই নারী। এ ছাড়া আছে প্রতিবন্ধী, শিশু, বয়স্ক মানুষ, অনেকে কোলে শিশু সন্তান নিয়ে নেমেছেন ভিক্ষায়। গ্রামে কাজ না থাকায় গত ছয় মাসের মধ্যে রাজধানীতে ঢুকেছেন অনেক ভিক্ষুক। জুমার নামাজের সময় বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনেই ছিল শতাধিক ভিক্ষুক। গত ২৯ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতালের দিন আজমপুরের এক ফার্মেসি ব্যবসায়ী বলেন, আধা ঘণ্টায় একজন কাস্টমার আসেননি, ভিক্ষুক এসেছেন ৬-৭ জন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব ভিক্ষুকের অনেকে এক বছর আগেও ভিক্ষা করতেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাওয়া সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও শিশুসন্তানকে নামিয়ে দিয়েছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে। অনেক কর্মক্ষম নারী পরিবারের সদস্যের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বোরকা পরে নেমেছেন ভিক্ষার থালা হাতে। আবার শুধু অভ্যাসবসত এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজধানীতে ভিক্ষা করছেন এমন মানুষের সন্ধানও মিলেছে। কর্মক্ষম হলেও ভিক্ষাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে বেদে সম্প্রদায়ের কিশোরীরা। এসব ভিক্ষুকের বড় অংশই আবার সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়মিত বিভিন্ন ভাতা পান।
বেগুনবাড়ী বস্তি থেকে প্রতিদিন সকালে প্রতিবন্ধী ছেলে রিয়াদকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে হাতিরঝিলের এফডিসি প্রান্তে এসে রাতঅবধি ভিক্ষা করেন তার মা। সিগন্যাল পড়লেই দৌড়ে যান এক গাড়ি থেকে আরেক গাড়িতে। তিনি জানান, তাদের বাড়ি বগুড়ায়। রিয়াদের বাবা রিকশা চালান। জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী রিয়াদ। তিন মাস পর পর ২৬০০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। সংসারের খরচ মেটাতে ও ছেলের চিকিৎসার জন্য ভিক্ষা করেন। কর্মক্ষম হয়েও কাজ না করার কারণ জানতে চাইলে রিয়াদের মা বলেন, কাজ করলে খুব বেশি টাকা পাওয়া যায় না। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ছেলেকে একা ঘরে রেখে কাজে যাওয়াও সম্ভব নয়।
হাতিরঝিলের এই স্থানটিতে প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ জন নিয়মিত ভিক্ষা করেন। বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষ ও প্রতিবন্ধী। কোলে দুধের শিশু নিয়েও এক তরুণীকে নিয়মিত ভিক্ষা করতে দেখা যায়। যদিও একই স্থানে প্রতিদিন রুমাল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন পঞ্চাশোর্ধ্ব নিলুফা।