দেওয়ানবাগ ডেস্ক: নদী ভাঙনে প্রতি বছর সারা দেশে হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা। নদীর গতিপথ বদলে পাল্টে যাচ্ছে স্থানীয় মানচিত্র। বসতভিটা, জায়গাজমি সব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। একসময়ের অবস্থাপন্ন মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে এখন অমানবিক জীবন যাপন করছে। রাস্তাঘাট, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদরাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমি নদীর গর্ভে চলে যাচ্ছে বলে সর্বশেষ জরিপে প্রকাশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় নদীর গতিপথ রুখে দেওয়ার জবরদস্তিমূলক চেষ্টার কারণে দেশের বিভিন্ন নদীতে ভাঙন হচ্ছে। এ ছাড়া অপরিকল্পিত খনন, ড্রেজিং ও বালু তোলার কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছে নদী। ভাঙন রোধে সরকারি প্রচেষ্টায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ভাঙন নিয়ন্ত্রণ কাজে নিয়োজিতদের জবাবদিহির অভাবে এর কার্যকর সুফল পাওয়া যায় না। ফলে বছর বছর বরাদ্দ বাড়লেও ভাঙনকবলিত মানুষ তার সুফল পায় না।
সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পূর্বাভাসে বলা হয়, এ বছর দেশের ১৩ জেলার ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের কবলে পড়বে। এ কারণে ফসলি জমির পাশাপাশি ঘরবাড়ি হারাতে পারে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ। এরই মধ্যে গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় ভাঙন শুরু হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সিইজিআইএসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, তীব্র ভাঙনের মুখে পড়তে পারে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ফরিদপুর ও মাদারীপুর। তবে নদীবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিইজিআইএসের পূর্বাভাসের তালিকায় না থাকলেও শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় কয়েক বছর ধরে তীব্র ভাঙন দেখা যায়। এ তিন জেলায় এবারও নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিচ্ছে। সিইজিআইএস সাধারণত ভাঙন ঠেকানোর উদ্যোগ নিতে ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে তাদের গবেষণালব্ধ তথ্য সরকারকে দিয়ে থাকে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোও সংস্থাটির তথ্য ব্যবহার করে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের সম্পদ ও জীবনের ক্ষতি মোকাবিলায় উদ্যোগ নেয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা সিইজিআইএস মূলত যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার সম্ভাব্য ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে থাকে। ভাঙনের কারণ হিসেবে সংস্থাটি বন্যার পানির স্রোত ও নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলাকে দায়ী করেছে। মূলত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় নদীতীরবর্তী যেসব এলাকার মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি থাকে, সেসব এলাকায় ভাঙন বেশি হয়। পদ্মা ও যমুনার তীরে এ ধরনের মাটি বেশি থাকায় ভাঙনও বেশি হচ্ছে। সিইজিআইএসের সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪৫ বছরে দেশের ১ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা নদীতে বিলীন হয়েছে। এতে প্রায় ১৭ লাখ ১৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ভাঙনঝুঁকির মাত্রা কমে আসছে : সিইজিআইএসের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান অবশ্য বলছেন, সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের ফলে গত দেড় যুগে নদী ভাঙনে ঝুঁকির মাত্রা অনেকটা কমিয়ে আনা গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা নদী ভাঙনের পূর্বাভাস দিয়ে আসছি ২০০৫ সাল থেকে। তখন এরকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছিল অন্তত ৫০টি, এখন সেটা ১৭টিতে নেমে এসেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন নদীতীর রক্ষা উদ্যোগের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন নদী ভাঙনের প্রবণতা দেখা যায় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত। সিইজিআইএস এবার তিনটি নদীর ভাঙনের ঝুঁকির পূর্বাভাস দিয়েছে। যমুনা, গঙ্গা, পদ্মা- এ তিনটি বড় নদীর ১৭টি জায়গা চিহ্নিত করেছি। এ ভাঙনের পূর্বাভাসে আমরা বলেছি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো বিলীন হওয়ার এ আশঙ্কা প্রায় ৫০%।’
সিইজিআইএস মনে করে, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও মাদারীপুর- এ চার জেলা এবার নদী ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ বাকি জেলাগুলো হলো- কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, মানিকগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ফরিদপুর। ভাঙনপ্রবণ ১৭ জায়গার মধ্যে নয়টি যমুনায়, ছয়টি গঙ্গায় আর দুটি পদ্মায়। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এসব এলাকার প্রায় ৬০০ হেক্টর কৃষিজমি, ১৬৫ হেক্টর বসতবাড়ি, সোয়া ২ কিলোমিটার সড়ক, ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার বাঁধ, ২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১৭টি মসজিদ, পাঁচটি হাঁটবাজার, দুটি কবরস্থান, একটি এতিমখানা ও অন্যান্য স্থাপনা ভাঙনের কবলে রয়েছে। জলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা: নদী ভাঙন ঠেকাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ জলে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিক উদ্যোগের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢাললেও ভাঙন রোধে কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যায় না। বিপর্যস্ত কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ভাঙনকবলিত এলাকা রক্ষায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তাসহ অর্ধশতাধিক নদীকে বশে আনতে চলছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ। কিন্তু এর সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ ও তাদের সম্পদ রক্ষার নামে ইতোমধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা পানিতে ভেসে গেছে। ভাঙন রোধ হয়নি। এমনকি সাধারণ মানুষেরও কোনো উপকার হয়নি। কিন্তু এ ভাঙন খেলায় কেউ না কেউ লাভবান হচ্ছে। দুই জেলায় অর্ধশতাধিক নদীর ভাঙন রোধে বর্তমানে ২ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকার পাঁচটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সুফল মিলবে বলে দাবি করেছেন উত্তরাঞ্চল পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। দেশের বিভিন্ন চিহ্নিত এলাকায় নদী ভাঙনের দুর্ভোগ যেন সাধারণ মানুষের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢলে-ঢেউয়ে-খরস্রোতে বয়ে চলা নদীগুলো প্রতি মুহূর্তে গ্রাস করে নিচ্ছে দুই পারের সবকিছু। সর্বহারা মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বছর ঘুরে আবারও বন্যা ও ভাঙনে পড়ে দারিদ্র্যের চাকায় পিষ্ট হয়। নদীর আগ্রাসন রুখতে সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ প্রায় অর্ধশত নদ-নদী প্রবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে আবার ১৬টি আন্তদেশি নদী রয়েছে। এ দুই জেলায় ভাঙনের ভয়াবহতা বেশি। ভাঙনকবলিত মানুষের সংখ্যাও বেশি।