বিশ্বে শান্তি স্থাপনে উন্নত দেশগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি

বিশ্বে শান্তি স্থাপনে উন্নত দেশগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি

এ কে এম আতিকুর রহমান: গত ২১ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস। ১৯৮২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার দিবসটি পালিত হলেও ২০০২ সাল থেকে আজকের দিনটিতে অর্থাৎ ২১ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও প্রতিবছর এই দিবস পালনের জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। গত দুই বছরের চেয়ে করোনা সংক্রমণ অবস্থার উন্নতি হওয়ায় এবারের আয়োজনে হয়তো খানিকটা ব্যাপকতা আসতে পারে।

সরকারের পক্ষ ছাড়াও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের পক্ষ থেকে দিবসটি উদযাপনের জন্য নানা কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে যে উদ্দেশ্যে দিবসটি পালন করা হয় অর্থাৎ বিশ্ব শান্তি স্থাপনে জনগণকে সচেতন করা, সেদিকেই প্রতিটি আয়োজক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বারোপ করবে বলে মনে করি।
দিবসটি পালনকে অর্থবহ করার জন্য প্রতি বছরই একটি করে প্রতিপাদ্য বিষয় বা থিম নির্বাচন করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘জাতি বিদ্বেষের সমাপ্তি ঘটাও, শান্তি প্রতিষ্ঠা করো।’ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বের প্রত্যেক মানুষকে অসহিংসতা অনুশীলনের মাধ্যমে শান্তির আদর্শগুলো শক্তিশালী করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্র ও পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীর প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণা মিশ্রিত বক্তব্য দেওয়া এবং সহিংসতা বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের একত্রে জাতি বৈষম্য আচরণ প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে এবং জাতি বৈষম্য বিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। এবারের উদযাপনটিতে অন্যান্য বিষয়ছাড়াও এ বিষয়ে বেশি জোর দেওয়ার কথা।

কভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ অনেকটা কমে এলেও বিশ্ব এখনো করোনামুক্ত হতে পারেনি। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মানুষের জীবনে আরেক বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলছে। জীবন আর জীবিকা এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তা থেকে কবে মানুষ মুক্তি পাবে কেউ জানে না। উন্নত বিশ্ব অর্থাৎ ধনী দেশগুলোর উদ্দেশ্য যদি আর্থিক লাভের জন্য হয় সেক্ষেত্রে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে সামাল দেওয়া উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। করোনার ধাক্কা না উতরাতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ববাসীকে এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে যাচ্ছে যে শান্তির চিন্তা দূরের কথা, দরিদ্র মানুষগুলো না জানি আগামী বছর শান্তি দিবস উদযাপনের আগেই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে যায়। বিশ্ব নেতারা শান্তির চিন্তা না করে যদি ক্ষমতা বিস্তারের বা অস্ত্র বিক্রির কথা চিন্তা করেন, তাহলে বিশ্বে কিভাবে শান্তি স্থাপন আসবে? গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢেলে কি সেই গাছ বাঁচানো যায়? বিশ্ব রাজনীতির সমীকরণ কি কোনোদিন শান্তি স্থাপনের পথে হাঁটতে দেবে না?
বিশ্বে শান্তি স্থাপনের পথে বড় অন্তরায় হচ্ছে উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা। ওই সব দেশের মানুষ যদি উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোর মানুষকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে না দেখে, তাহলে বিশ্বশান্তির স্বপ্ন কোনোদিন বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে না। দরিদ্র দেশের দরিদ্র মানুষগুলোর প্রতি মনুষ্যত্ব বিবর্জিত বিদ্বেষপরায়ণ ধনী মানুষগুলোর জাতিগত বৈষম্যমূলক আচরণ ও মানসিকতা দূর করতে না পারলে আমরা যতই শান্তির কথা উচ্চারণ করি না কেন, শান্তির পৃথিবী কোনোদিন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত জরুরি। জানিনা এ ব্যাপারে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হবে কিনা।
এ প্রসঙ্গে আমি ছোট একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। একবার মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘স্পাউজেজ অ্যাসোসিয়েশন’ দরিদ্র শিশুদের সাহায্যার্থে একটি চ্যারিটি মেলার আয়োজন করে, যেখানে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ওই দেশে অবস্থিত সব দূতাবাস অংশ নেয়। আমরাও একটি স্টল পাই। আমাদের স্টলটির অবস্থান এমন একটি স্থানে ছিল যেখানে মেলার দর্শনার্থীদের সহজেই চোখ পড়ে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার স্টলটির অবস্থান ভালো জায়গায় ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার (আমার ভালো বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও) অভিযোগ করলেন কিভাবে আমাদের এত ভালো জায়গায় স্টল দেওয়া হলো অথচ তাদেরটা খারাপ জায়গায় দেওয়া হলো। কর্তৃপক্ষ যেহেতু লটারির মাধ্যমে স্টল বরাদ্দ দিয়েছিল, সেক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হয়নি। তারা ভেবেছিল বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় ছোট্ট দেশ, তাদের চেয়ে অর্থনৈতিক বা ক্ষমতায় অনেক পিছিয়ে। এটাই ছিল শ্বেতাঙ্গ হাইকমিশনারের অহংবোধের বহিঃপ্রকাশ। তাঁর বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ সেদিন আমাদের মনঃকষ্টের কারণ হয়েছিল।

পৃথিবীতে উত্তেজনা ও বিরোধ, জাতিগত ও বর্ণবৈষম্য, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অস্বীকার বহুবছর থেকেই চলে আসছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫০ বছর আগেই বুঝেছিলেন ওই বৈষম্যের নিষ্ঠুরতা। তাইতো তিনি জাতি আর বর্ণবৈষম্যের শিকার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারবঞ্চিত সেই সব মানুষের মুক্তি আর স্বাধিকারের কথা দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি জানতেন যে ওই বৈষম্য বজায় রেখে বা অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা যতই করা হোক না কেন, সবই বৃথা যাবে। তাইতো তিনি বিশ্ববাসীকে সব বিভেদ, দ্বেষ, হিংসা, যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি ভুলে গিয়ে শান্তি স্থাপনের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে একই পতাকাতলে সমবেত হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আমরা, সাধারণ মানুষ, ধনী-দরিদ্র সব দেশের মানুষ, পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাস করি না কেন, শান্তিতে থাকতে চাই। শুধু কিছু মানুষ, যাঁরা আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরাই যে সব ভণ্ডুল করে দিচ্ছেন। ক্ষমতার প্রতি আসক্তি এবং বিশ্বব্যাপী নিজেদের প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করার কৌশল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমাদের শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না। এই ধারা আগের মতোই বহমান রয়েছে। ওই সব নেতার মুখ থেকে যতই শান্তির বাণীর নিঃসরণ আমরা দেখি না কেন, সেসবই এক ধরনের ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। তা না হলে সেই ১৯৮২ সাল থেকে আজ অবধি বিশ্বের প্রতিটি দেশ শান্তি স্থাপনের অঙ্গীকার করে যাচ্ছে, অথচ অশান্তির বীজ বপন কখনো বন্ধ হয়নি। শান্তি স্থাপনই যদি বিশ্বনেতাদের কাম্য হতো, তাহলে আজও কেন মানুষে মানুষে এত সংঘাত, বিভেদ ও যুদ্ধবিগ্রহ? কেন ফিলিস্তিন, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইরাক, লিবিয়া, ইউক্রেন, লেবানন, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে অশান্তির উত্তাল তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে?

বাস্তবে আমরা কী দেখছি? আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালন উপলক্ষে বিশ্বের নেতারা প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারের নামে কথার মহাসমুদ্র তৈরি করে যাচ্ছেন প্রতিবছর। কয়েক দিনের মধ্যে তাঁরাই আবার মেতে উঠছেন প্রভুত্ব বিস্তারে। যুদ্ধবিগ্রহ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতিগত বৈষম্য এবং অধিকার বঞ্চনার কারণে শান্তির আলোকরশ্মি মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এক্ষেত্রেও শক্তিশালী দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্ব সংরক্ষণ ও প্রভাব বিস্তারের কৌশল কাজ করছে। তাঁরা যদি কথায় আর কাজে আন্তরিক হতেন, তাহলে বিশ্বের চিত্রটিই বদলে দিতে পারতেন। অথচ এত বছরেও পৃথিবীতে শান্তির হাওয়া বইল না। ক্ষমতার অন্ধ মোহ যে তাঁদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই ব্যর্থতার দায়ভার অবশ্যই একদিন বিশ্বের নেতাদেরই নিতে হবে। সাধারণ মানুষ কোনো অশান্তি চায় না।

করোনা মহামারিতে বিশ্বের মানুষ ভালো নেই। দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। বিশ্ব অর্থনীতি যেদিকে ধাবিত হচ্ছে তাতে আগামী বছরগুলোতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় যে নেমে আসবে না সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। দুর্ভিক্ষ নামের মহামারির ছোবল থেকে মানুষকে কতটুকু রক্ষা করা যাবে তা এই মুহূর্তে বলা না গেলেও হয়তো কিছুটা আঁচ করা যায়। বিশ্ব অর্থনীতির ভিত্তি টেকসই এবং তাতে সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করাই ওই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে, শান্তি স্থাপনের পথ মসৃণ করতে পারে। বিশ্বের যে প্রান্তেই যে মানুষই বসবাস করুক না কেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে অবহেলিত মানুষের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা গেলে শান্তি স্থাপনের কাজটি সহজ হবে।
শান্তির অর্থ হচ্ছে একে অপরকে বুঝতে পারা এবং যেকোনো সমস্যা সমাধানে আমাদের মধ্যে ঐক্য বজায় রেখে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা। যেকোনো গোলযোগ বা বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তির অন্য নাম হচ্ছে শান্তি। আর শান্তির পূর্বশর্ত হচ্ছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমব্যথী হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস স্থাপন। এ বছর দিবসটি পালনের জন্য গৃহীত অনুষ্ঠানসূচিতে এসব বিষয়ে জনগণকে অবশ্যই সচেতনকরতে হবে এবং বাস্তব অনুশীলনের পথ সুগম করতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।

বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে মানবজাতির সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণ অর্জন কখনোই সম্ভব হবে না। বিশ্বকে একটি পরিবার মনে করে সবাইকে কাজ করতে হবে। ধনী-দরিদ্র, উন্নত-অনুন্নত দেশের ভেদাভেদ ভুলে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্বকে সাজাতে হবে। জানি না কবে সেদিন আসবে যখন উন্নত দেশগুলোর মানুষের, বিশেষ করে নেতৃত্বের মনমানসিকতার পরিবর্তন হবে এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবে। সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। তাই কারো দিকে তাকিয়ে না থেকে আসুন আমরা আমাদের প্রয়াস অব্যাহত রাখি, আমাদের কণ্ঠকে সোচ্চার করি। প্রতিটি দেশের মানুষকে যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং স্থায়ীভাবে শান্তি স্থাপনের জন্য তাদের নেতাদের চাপ দিতে হবে। একদিন অবশ্যই সবার এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা সাফল্য বয়ে আনবে, একটি শান্তির পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *