মাসুদ করিম
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। তবে বিশ্বে শান্তিরক্ষার এ কাজটি সহজ নয়। শান্তিরক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এ পর্যন্ত ১৪২ বাংলাদেশি সৈন্য প্রাণ দিয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ২৪১ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তিরক্ষায় তারা রেখেছেন অসামান্য অবদান।
সোমবার আফ্রিকার প্রজাতন্ত্রে তিনজন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ মহাসচিব ও ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফানে ডুজারিক বলেছেন, মধ্য আফ্রিকার প্রজাতন্ত্রে বিস্ফোরণে তিনজন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর মৃত্যুতে মহাসচিব গভীরভাবে শোকাহত। একজন শান্তিরক্ষী আহত হয়ে সংকটজনক অবস্থায় রয়েছেন। মহাসচিব নিহত শান্তিরক্ষীদের পরিবার এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি আহত শান্তিরক্ষীর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। মহাসচিব বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের টার্গেট করে হামলা আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে। তিনি মধ্য আফ্রিকার কর্তৃপক্ষকে অপরাধীদের চিহ্নিত করার জন্য সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। এতে করে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হবে। মহাসচিব রাত্রিকালে বিমান চালানার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য মধ্য আফ্রিকার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শান্তিরক্ষীরা জাতীয় কর্তৃপক্ষকে সমর্থন দিতে প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। মহাসচিব মধ্য আফ্রিকার প্রজাতন্ত্রের সরকারের প্রতি তার সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বুধবার ঢাকায় জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মধ্য আফ্রিকার প্রজাতন্ত্রে তিনজন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর অকাল মৃত্যুতে জাতিসংঘ গভীরভাবে শোকাহত। আমাদের আন্তরিক শোক কর্মরত অবস্থায় জীবনদানকারী জাহাঙ্গীর আলম, জসিম উদ্দিন ও শরীফ হোসেনের পরিবারের প্রতি। আমরা চিকিৎসাধীন আহত মেজর আশরাফুল হকের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা কর্তব্য পালনকালে বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। শান্তি ও ত্যাগের ব্রত নিয়ে কর্মরত নারী ও পুরুষ যারা জীবনকে বিপন্ন করেছেন; তাদের প্রতি আজ ও প্রতিদিন আমরা সংহতি জানিয়ে পাশে দাঁড়াই।’
সূত্রমতে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী হতে এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অধীনে এক লাখ ৮৩ হাজার ৩৭৮ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ১৪২ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২৪১ জন। বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অধীনে নয়টি মিশনে ছয় হাজার ৩২৪ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী মোতায়েন রয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন ৩৭১ জন নারী শান্তিরক্ষী। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী হতে এ পর্যন্ত বিশ্বের ৪৩টি দেশে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের পলিসি অ্যাডভাইজার হিসাবে এবং লাইবেরিয়ায় ফিল্ড অপারেশনে দায়িত্ব পালন করেছেন পুলিশের কাউন্সিলর (জাতিসংঘ) তাপতুন নাসরিন। তিনি বুধবার বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় দায়িত্ব পালন সব সময়েই চ্যালেঞ্জের। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে মাইন অপসারণের সময়ে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা আত্মত্যাগ করেছেন। তিনি তাদের গৌরবময় আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন।
তাপতুন বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় যারা প্রাণ হারান তাদের স্মরণে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘ফর দ্য ফলেন’ নামে অনুষ্ঠান হয়। জাতিসংঘের সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোও তাতে অংশ নেয়। এভাবে তাদের অসামান্য অবদানের বিষয়টি স্মরণ করা হয়। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি তাপতুন আরও বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় স্থাপনা নিরাপত্তায় সৈন্যরা দায়িত্ব পালন করেন। তবে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং হলো নিরস্ত্রকরণ। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা এই কাজ করতে গিয়েই মারা গেছেন। তারা মাইন অপসারণের সময়ে অ্যামবুশে মারা গেছেন। এছাড়াও, শান্তিরক্ষীরা পিস বিল্ডিং তথা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সামর্থ্য বৃদ্ধির কাজও করেন।
তিনি বলেন, সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে নারী ও শিশুরা বেশি আক্রান্ত হন। তাদের অনেকে সাহস হারিয়ে ফেলেন। তাদের মধ্যে সাহস ও আস্থা ফেরাতে নারী শান্তিরক্ষীরা কাজ করেন। আক্রান্ত মেয়েরা দেখতে পায় যে, বিদেশি একটি মেয়ে সাহস নিয়ে বৈরী পরিবেশে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। এসব দেখে মেয়েদের মধ্যে সাহস ও আস্থার সঞ্চার হয়। কী ধরনের বৈরী পরিবেশে নারী শান্তিরক্ষীরা কাজ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাথরুম ও টয়লেট সমস্যার পাশাপাশি মশা-মাছির সমস্যা আছে। তার ওপর পরিবারের চিন্তাও কম সমস্যা নয়।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অপারেশন কার্যক্রম পরিচালনার সময় সোমবার মধ্য আফ্রিকার প্রজাতন্ত্রে বিস্ফোরণে তিনজন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত এবং একজন আহত হয়েছেন। স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের একটি গাড়ি ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিহত তিনজন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর থানার কাটিঙ্গা গ্রামের সৈনিক জসিম উদ্দিন (৩১), নীলফামারীর ডিমলা থানার দক্ষিণ টিটিপাড়া গ্রামের সৈনিক জাহাংগীর আলম (২৬) এবং সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার বাড়াক রুয়া গ্রামের সৈনিক শরীফ হোসেন (২৬)। বিস্ফোরণে টহল কমান্ডার মেজর আশরাফুল হক আহত হয়েছেন।