অর্থ ডেস্ক: বিশ্ব ক্রমশই তীব্র খাদ্যসংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে সতর্কবার্তা জারি করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের খাদ্য, কৃষি এবং পরিবেশসংক্রান্ত পাঁচটি বিশেষায়িত সংস্থার সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক ‘স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বিশ্ব জুড়ে যত মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে ভুগেছে, দুই বছরের অধিক সময় ধরে বিরাজ করা করোনা মহামারির কারণে সেই সংখ্যায় যোগ হয়েছে আরো প্রায় ১২ কোটি ২০ লাখ মানুষ।
এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০১৯ সালে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলি আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হাসিলের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু বর্তমানে যে হারে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভবপর হবে না। বরং উলটা এই সময়সীমার মধ্যে আরো ৬০ কোটি মানুষ নূতন করে ক্ষুধার্ত-তালিকায় যুক্ত হতে পারে। আমরা দেখছি, চার বৎসর পূর্বে দুর্ভিক্ষ হতে মাত্র এক ধাপ দূরে রয়েছে এমন লোকের সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৩ কোটি। কিন্তু বর্তমানে তা আড়াই গুণের অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৮৩ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত্রি যাপন করে এবং প্রায় ৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের কিনারায় অবস্থান করছে। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা, অর্থাৎ যারা খাদ্যের পরিমাণ বা গুণমানের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হয়েছে, বর্তমানে তাদের সংখ্যা বেড়ে প্রায় সোয়া দুই শত কোটি হয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, খাদ্যসংকটের তীব্রতা পৃথিবীর সকল প্রান্তে এক রকম নহে। দারিদ্র্য ও সংঘাতপীড়িত অঞ্চলগুলিতেই খাদ্যসংকটের তীব্রতা অনেক অধিক। এই ধরনের জনপদে কৃষিকাজের সহিত যুক্ত ব্যক্তিদের অবস্থাও ভালো নহে। এমনিতেই কৃষিকাজের ব্যয় বাড়ছে অনেক গুণ। অন্যদিকে ফড়িয়া বা আড়তদার হিসাবে এক প্রকারের মধ্যস্বত্বভোগী পুঁজিপতিদের উত্থান হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের সমাজে, যারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ফসলের মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্মরণ করা যেতে পারে, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি সরকারি প্রচেষ্টায় ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষিকে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছিল গত শতকের শেষ দশক পর্যন্ত। কিন্তু বিশেষ কিছু কারণে কৃষিতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা তুলে নিতে বাধ্য হয় দরিদ্র দেশগুলি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সারা বিশ্বেই কৃষিপণ্যের ব্যবসা এক অর্থে কিছু শক্তির নিকট কুক্ষিগত। ২০২০ সালের হিসাব মতে, অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের কৃষিপণ্যের বাজার কুক্ষিগত রয়েছে বিশ্বের মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠানের হাতে।
এজন্য অনেকে মনে করেন, বিশ্বে খাদ্যসংকট বিরাজ করলেও তার নেপথ্যে আরো অনেক কারণ রয়েছে। এই খাদ্যঘাটতি কেবল উৎপাদন স্বল্পতার জন্য নহে বরং ক্রয়ক্ষমতার সংকটও রয়েছে। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট যতখানি প্রকট, খাদ্যের মজুত ততখানি কম নহে। তার কারণ হলো, খাদ্যদ্রব্যের বাণিজ্যিক সরবরাহ এবং বণ্টন গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে কুক্ষিগত। এজন্য খাদ্যের মূল্যের উপর তাদেরই প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। অস্বস্তিকর বিষয় হলো, কোম্পানিগুলোর নিকট কী পরিমাণ শস্য রয়েছে, সেই তথ্যও সঠিক সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না- প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা ৮০০ কোটি হতে ২০৫০ সালে আনুমানিক প্রায় ৯৭০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় উপাত্তের ব্যবহার, উন্নত অবকাঠামো এবং পরিবহন ব্যবস্থার সাহায্যে খাদ্য সংগ্রহ, মজুত, সরবরাহ ও বণ্টন খাদ্যের নিরাপত্তাকে ত্বরান্বিত করা এখন প্রতিটি রাষ্ট্রের কর্তব্য। ইহা সারা বিশ্বের সম্মিলিত সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা। কারণ, পৃথিবীর কোনো কিছু না থাকলেও বাঁচিয়া থাকা সম্ভব হইবে, যদি খাদ্যের সংস্থান নিশ্চিত করা যায়