সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক: ব্রতচারী গুরুসদয় দত্ত প্রায় ১০০ বছর আগে বিশ্বমানব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং বলে দিয়েছিলেন বিশ্বমানব হতে হলে ঠিক কী করতে হবে। এখন জাতিসংঘও বিশ্বের সব শিক্ষার্থীকে বিশ্বনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে এবং তারাও বলে দিয়েছে একজন বিশ্বনাগরিক হতে হলে ঠিক কী কী করতে হবে। জাতিসংঘ বলেছে, বিশ্বনাগরিক হতে হলে আমাদের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো স্থানীয় ও বৈশ্বিকভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে এবং আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে এ পৃথিবীকে আরও ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ, সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ ও টেকসই একটি গ্রহে পরিণত করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখা। কিছুটা আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বিশ্বমানব হওয়ার জন্য গুরুসদয় দত্তের দেওয়া শর্তের সঙ্গে জাতিসংঘের একজন বিশ্বনাগরিকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অদ্ভুত মিল রয়েছে। অর্থাৎ নিজেকে একজন শাশ্বত বাঙালি হিসাবে গড়ে তুলতে পারলে জাতিসংঘের বিশ্বনাগরিক হতে আর তেমন বেগ পেতে হবে না। যাই হোক, গুরুসদয় দত্তের কথায় এতদিন ঠিকভাবে কান না দিলেও জাতিসংঘের বিশ্বনাগরিক হওয়ার বিষয়টি আমরা মেনে নিয়েছি এবং আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমে তা অন্তর্ভুক্ত করেছি।
এই যে সক্রিয় ভূমিকার কথা বলা হলো, এখানে একটু থামি। স্বাভাবিকভাবে মনে হয়, উন্নত দেশগুলোই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে। কারণ, তাদের অবদান রাখার সামর্থ্যও যেমন বেশি, তাদের শিক্ষাও তেমন অনেক উন্নত। কিন্তু এত সামর্থ্য ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের কেন খুব একটা সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে না, তা বোঝার ক্ষেত্রে জার্মানির একটি ঘটনা হয়তো কিছুটা আলোকপাত করতে পারে।
২০১৫ সালের ১৭ জুলাই জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মের্কেলের সঙ্গে লেবানন থেকে আসা এক উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনি কিশোরীর দেখা হয়। মেয়েটির পরিবার জার্মানিতে আশ্রয় চেয়েছিল, কিন্তু জার্মানি তাদের আশ্রয় না দিয়ে বরং দেশ থেকে বের করে দেয়। রিম নামের সেই মেয়েটি সুযোগ পেয়ে একেবারে চোস্ত জার্মান ভাষায় মের্কেলকে বলে ফেলে, ‘যখন দেখি অন্যরা জীবনকে উপভোগ করছে, কিন্তু আমি পারছি না, তখন খুব কষ্ট হয়। আমি জানি না আমার কী হবে শেষ পর্যন্ত।’ মের্কেল উত্তরে বলেন-দেখ, রাজনীতি খুব কঠিন। লেবাননে তো লাখ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু আছে। আমরা তো সবাইকে নিতে পারব না। মের্কেলের উত্তর শুনে মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে। মের্কেল তার পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষীদের ইশারায় শেষ পর্যন্ত থেমে যান।
এরপর মের্কেলের বিরুদ্ধে ভয়ানক সমালোচনা শুরু হয়। তিনি যে একজন অসহনশীল, অসংবেদনশীল, কঠিন হ্রদয়ের মানুষ, সে কথাটাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা হতে থাকে। শেষমেশ এ সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে মের্কেল তার সিদ্ধান্ত পালটান এবং রিম ও তার পরিবারকে আশ্রয় প্রদান করেন। কিন্তু এর পরপরই উলটো শুরু হয় সমালোচনা। তাকে এমন একজন সেন্টিমেন্টাল মহিলা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়, যিনি কোনো শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। জার্মান অভিভাবকরা বললেন, এভাবে যদি উদ্বাস্তুদের আসার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তাদের সন্তান-সন্ততিদের জীবনযাত্রার মান অনেক কমে যাবে। অনুন্নত দেশের এসব অচেনা, অসভ্য ও অকর্মণ্য মানুষকে আশ্রয় দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনার কোনো মানে হয় না।
আমরা যদি এবার বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাই, তাহলে দেখব এখানকার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। বাংলাদেশ সরকার এ পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। জার্মানির মতো এখানেও অনেকে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, তবে তা খুব তীব্র নয়। মোটা দাগে জার্মানদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের তুলনা করলে দেখা যাবে, সামর্থ্য ও স্থানের চরম অপ্রতুলতা সত্ত্বেও বিশ্বনাগরিক হিসাবে বাংলাদেশিরা এগিয়ে আছে। তাহলে জার্মানরা কি আমাদের চেয়ে কম মানবিক? বিশেষজ্ঞরা বলবেন, ঠিক তা নয়, তাদেরও মানবিকতা আছে, তবে সেটা ভিন্ন ধাঁচের। যে ‘অর্থডক্স মানবিকতা’ পৃথিবীর সব মানুষের সমান বা ন্যায্য অধিকারের কথা বলে, এটি সেরকম মানবিকতা নয়।
জার্মানদের মানবতাবাদকে বইয়ের ভাষায় ‘ইভালুশনারি মানবতাবাদ’ বলা যায়। এর চরম উদাহরণ হচ্ছে হিটলারের নাৎসিবাদ। যা হোক, এ ধরনের মানবতাবাদ মনে করে, যোগ্যদেরই টিকে থাকার অধিকার আছে। ইউরোপ আফ্রিকাকে পদতলে রাখবে, কিংবা বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী বোকা ব্যবসায়ীর ব্যবসা কেড়ে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। একজন আইনস্টাইন বা বেটোভেনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে একজন মাতাল অপদার্থ লোকের অভিজ্ঞতার তুলনা করাটা যেমন হাস্যকর, তেমনি একটি উন্নত সভ্য দেশের মতো করে একটি অনুন্নত অসভ্য দেশকে দেখাও ঠিক নয়। জার্মানরা রিমদের ছিটেফোঁটা সাহায্য করতে পারে, কিন্তু পিছিয়ে পড়া স্বল্পশিক্ষিত, অসভ্য, অযোগ্য লোকজন এসে তাদের ছেলেমেয়েদের বারোটা বাজাবে, সেটা তারা সহ্য করবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শুধু জার্মানি নয়, পশ্চিমা সব দেশই ‘অর্থডক্স মানবতাবাদে’র চেয়ে ‘ইভালুশনারি মানবতাবাদে’ বেশি বিশ্বাস করে। এর অর্থ, কেবল যোগ্যতা থাকলেই তারা আমাদের সঙ্গে মানবতাবাদী আচরণ করবে, নচেৎ নয়।
ফলে আমরা তাদের মধ্যে যে রকম বিশ্বনাগরিকত্ব দেখতে চাই, তারা ঠিক সেভাবে বিশ্বনাগরিক হতে চাইবে না। কিন্তু জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বেশিরভাগ নাগরিক বিশ্বনাগরিক না হলে কোনো উন্নয়ন তো টেকসই হবেই না, এ পুরো গ্রহটাই শেষ পর্যন্ত বসবাসযোগ্য থাকবে কিনা সন্দেহ। এ কারণে উন্নত বিশ্বকে বুঝতে হবে ওরা যতই অর্থবান, বলবান বা বুদ্ধিমান হোক, আমাদের ছাড়া ওদের চলবে না। যেমন আমাদের ছাড়া ওদের একার পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। আমাদেরও বুঝতে হবে, উন্নত বিশ্বের ‘অর্থডক্স মানবতাবাদে’র ওপর ভরসা করে ওদের সাহায্য লাভের আশায় বসে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বরং ওদের ‘ইভালুশনারি মানবতাবাদে’র সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে।
এ কারণেই জাতিসংঘের আবেদনে সাড়া দিয়ে আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমে বিশ্ব নাগরিকত্বের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। যেসব যোগ্যতা থাকলে আমাদের শিক্ষার্থীরা শাশ্বত বাঙালি হতে পারবে, বা উন্নত বিশ্বের ‘ইভালুশনারি মানবতাবাদে’র সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারবে, সেসব যোগ্যতা যেমন-মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সৃষ্টিশীলতা, সূক্ষ্মচিন্তন দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, সহমর্মিতা ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এসবের অর্জন নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন স্থানীয় চাহিদা মেটাতে পারবে, তেমনি উন্নত বিশ্বের ‘ইভালুশনারি মানবতাবাদে’র সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বনাগরিক হয়ে নিজের দেশ ও পুরো বিশ্বকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে।