বাণিজ্য ডেস্ক: ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় ধাক্কা হয়ে আসে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। এতে জ্বালানির দাম সাময়িক বাড়লেও আবার কমে এসেছে। পণ্যবাজারেও তেমন প্রভাব পড়েনি। ফলে সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল ছিল। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের তুলনায় এ বছর বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ, যা করোনা মহামারির পর সবচেয়ে বড় পতন।
বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘ক্রমবর্ধমান অসমতা’ শীর্ষক এ ফিচার প্রতিবেদনে ‘কমোডিটি মার্কেট আউটলুক’ প্রতিবেদনের উল্লেখ করে বলা হয়, গত অক্টোবরে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে সরবরাহ বিপর্যয়ের উদ্বেগে পণ্যবাজারে দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে এ প্রভাব খুব বেশি পড়েনি। এ বছর সার্বিকভাবে পণ্যের দাম কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। যদিও সব পণ্যের দামই ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের গড় দামের চেয়ে বেশি আছে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, আগামী বছর সার্বিকভাবে সব পণ্যের দাম কমবে ৪.১ শতাংশ। সরবরাহ বাড়ায় কৃষিপণ্যের দামও আগামী বছর কমে আসবে। এ ছাড়া বিভিন্ন মেটালের দাম ৫ শতাংশ কমবে ২০২৪ সালে। ২০২৫ সালে পণ্যবাজার স্থিতিশীল থাকবে। বর্তমান প্রান্তিকে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল গড়ে ৯০ ডলার থাকবে। তবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে আসায় আগামী বছর দাম আরো কমে গড়ে হবে ৮১ ডলার।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দরিদ্র দেশগুলো নিয়ে বলা হয়, ২০২২ সাল অনিশ্চয়তার বছর হলে ২০২৩ সাল হচ্ছে ‘অসমতার বছর’। কভিড-১৯-এ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায়, তখন পরিস্থিতি জটিল করে তুলল ইউক্রেন যুদ্ধ।
এই যুদ্ধ শেষ না হতেই শুরু হলো মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, ভঙ্গুরতা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা। ইত্যাদি কারণে দেশগুলোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া জটিল আকার ধারণ করে। যেকোনো সংকটেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র দেশগুলো। এসব দেশ এরই মধ্যে ভয়াবহ ঋণ সংকটে থাকায় প্রবৃদ্ধি অর্জনে চাপ আরো বেড়ে যায়। এ সময় আয়ের একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে অলনাইন গিগ ওয়ার্ক। এটি শ্রমবাজারে আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস পরিণত হয়েছে।
এদিকে মধ্য-আয়ের দেশগুলোতে অতিদারিদ্র্য কমলেও দরিদ্র যেসব দেশ যুদ্ধ, সংঘাতসহ ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে, তাদের পরিস্থিতি করোনোর আগের চেয়ে এখনো খারাপ অবস্থায় রয়েছে। এসব দেশের দারিদ্র্যের কারণে বৈশ্বিক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদন অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০২২ সালে তাদের বৈদেশিক ঋণ ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের পেছনে ব্যয় করেছে রেকর্ড ৪৪৩.৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোকে এ খাতে খরচ করতে হয়েছে ৮৮.৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালের চেয়ে ৪.৮ শতাংশ বেশি। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র দেশগুলো ঋণের চাপে পড়েছে।
সরবরাহ টান টান থাকবে নতুন বছরে: ২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে সরবরাহ ভালো থাকায় খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। তবে আগামী বছর এল নিনোর প্রভাবে খরায় উৎপাদন কমতে পারে, এতে সরবরাহ কিছুটা টান টান থাকবে। গত মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য কৃষকদের অধিক পরিমাণে খাদ্যশস্য ও তেলবীজ চাষাবাদে উৎসাহী করে তুলেছে। কিন্তু ২০২৪ সালে সরবরাহ টান টান থাকবে এল নিনোর প্রতিকূল আবহাওয়া, রপ্তানি সীমিতকরণ ও জৈব জ্বালানিতে বিপুল শস্যের ব্যবহারের কারণে। ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, টানা কয়েক বছর দাম বাড়ার পর এ বছর কমেছে গম, ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম। বিশেষত কৃষ্ণসাগরের পরিস্থিতি শিথিল হওয়া এবং বৈশ্বিক মন্দার ভয় কাটার কারণে। যদিও নতুন বছরে সরবরাহ উদ্বেগ ও মূল্যস্ফীতি থাকবে। কৃষি ব্রোকারেজ আইকন কমিডিটিজ সিডনির সেবা পরামর্শক পরিচালক ওলে হুই বলেন, ‘খাদ্যশস্যের সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে ২০২৩ সালে। বেশ কিছু অঞ্চলে উৎপাদন ভালো হয়েছে। যদিও আমরা এখনো বিপদমুক্ত নই। কারণ কমপক্ষে এপ্রিল-মে পর্যন্ত এল নিনোর পূর্বাভাস রয়েছে। ব্রাজিল গতবারের চেয়ে কম উৎপাদন করবে এবার। অন্যদিকে চীন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ গম ও ভুট্টা কিনে নিচ্ছে।
এ বছর এল নিনোর কারণে এশিয়ার বিশাল অঞ্চলে খরা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি ২০২৪ সালের প্রথমভাগ পর্যন্ত থাকতে পারে। ফলে চাল, গম ও পামতেলসহ বেশ কিছু পণ্যের সরবরাহ ঝুঁকিতে থাকবে। ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা আশা করছেন, বছরের প্রথমভাগে এশিয়ায় চাল উৎপাদন কিছুটা কমবে। একদিকে এল নিনোর কারণে খরা পরিস্থিতি অন্যদিকে সেচের পানির রিজার্ভ কমে যাওয়ায়। এসব কারণে ফসল উৎপাদনও কমবে। এতে ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চাল সরবরাহ টান টান থাকবে। এল নিনোর প্রভাবের কারণে এরই মধ্যে ভারত পূর্বাভাসে উৎপাদন কমার কথা জানিয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বে চালের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশটি রপ্তানি সীমিত করেছে। এ বছর অন্যান্য খাদ্যশস্যের দাম কমলেও চালের দাম বেড়ে ১৫ বছরে সর্বোচ্চ হয়েছে। এশিয়ার বেশ কিছু রপ্তানিকারক দেশে মূল্য ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ বেড়েছে।