সোশাল ইঞ্জিনিয়ারের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটারে ঢুকার পর শুরু হয় ‘ডিগার’ এর কাজ। ডিগার একজন দক্ষ হ্যাকার, যে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের গভীরে যেতে পারে। সবার অগোচরে থেকে ডিগার কম্পিউটার নেটওয়ার্কের প্রতিটি অংশ ম্যাপিং করতে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটারগুলো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত ছিল। যে যন্ত্রের মাধ্যমে এক কম্পিউটার আরেক কম্পিউটারের সাথে যুক্ত থাকে, সেটাকে বলে ‘সুইচ’। সাধারণত যেখানে নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি ভালো, সেখানে যেসব সুইচ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সীমিতসংখ্যক কম্পিউটারকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে দেয়, এটাকে বলে ‘ফ্রাগমেন্টেশন’। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে যেসব সুইচ ব্যবহার করা হয়েছিল, ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য সেগুলো ছিল কম দামী, সেগুলোতে ফ্রাগমেন্টেশন ছিল না, সকল কম্পিউটারই পরস্পর যুক্ত ছিল, এর মধ্যে ছিল সুইফট টার্মিনাল কম্পিউটারটিও। আর ডিগারের এটাই প্রয়োজন ছিল।
ডিগার নেটওয়ার্কের সুবিধা নিয়ে খুঁজতে শুরু করে, এরপর কোন কম্পিটারকে আক্রমণ করা যায়। একটি কম্পিউটারে যখন লগইন করা হয়, সেই ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড মেমরি বা ক্যাচে সংরক্ষিত থাকে। ডিগার সেখান থেকে তথ্য নিয়ে অন্য কম্পিউটারে প্রবেশ করার চেষ্টা করতে শুরু করে। তারা এভাবে এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে প্রবেশ করতে থাকে। লম্বা সময়ের জন্য তারা কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ছিল, মাসের পর মাস। তারা জানত, যেকোনো সময় তাদের অবস্থান সম্পর্কে যদি কেউ জেনে যায়, তাহলে তারা শেষ। ফলে তারা খুবই গোপনীয়তার সাথে নেটওয়ার্কে থেকে একের পর এক কম্পিউটারে প্রবেশ করতে থাকে, একসময় তারা তাদের কাংখিত সুইফট টার্মিনাল কম্পিউটারে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে অনুপ্রবেশের পর পরই ভিন্ন আরেক ফ্রন্টে কাজ শুরু করে হ্যাকাররা। হ্যাকিং করে টাকা সরালেইতো আর হবে না, সেটাকে ব্যাংকের মাধ্যমে তুলে কাগজের টাকায় রূপান্তর করে সরাতে পারলেই কেবল ডাকাতি সম্পন্ন হবে। তারা একজন চীনা নাগরিককে নিয়োগ করে, যে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় গিয়ে আরসিবিসি ব্যাংকে চারটি অ্যাকাউন্ট খোলে, সেগুলোর প্রত্যেকটিতে ৫ শত ডলার জমা রাখে, অ্যাকাউন্টগুলো পরবর্তী নয় মাস আর কোন লেনদেন হয়নি।
এদিকে হ্যাকাররা একটার পর একটা কম্পিউটারকে আক্রমণ করে অবশেষে সুইফট টার্মিনাল কম্পিউটারে পৌঁছে যায়, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে। এরপর তারা ৫ দিন অপেক্ষা করেছিল তাদের লেনদেনের অনুরোধ পাঠানোর জন্য। একদিন তারা লক্ষ্য করল, কিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুইফটের মাধ্যমে লেনদেনের অনুরোধ পাঠানো হয়, কিভাবে তারা তাদের ম্যানিলার ব্যাংকে টাকাটা পাঠাতে পারে। তারা ফেব্রুয়ারির চার তারিখকে আক্রমণের দিন হিসেবে বেছে নেয়, এটা কোনো কাকতালীয় বিষয় ছিল না। তারা এমনভাবে দিনটি ঠিক করে যাতে তারা ছুটির সময়টায় নির্বিঘেœ চুরি সম্পন্ন করতে পারে, এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের ছুটির কারণে তারা চার দিন সময় পেয়ে যায়।
২০১৬ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার, বাংলাদেশে সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস। বিকালের দিকে সুইফট টার্মিনালের অপারেটর কম্পিউটার বন্ধ করে অফিস ত্যাগ করেন। এর প্রায় তিন ঘন্টা পর হ্যাকাররা সুইফট কম্পিউটারে লগইন করে, রাত ৮টা ৩৬ মিনিটে। তারা জানত অথবা ধারণা করেছিল, ততক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল কর্মী বাসায় চলে গিয়েছেন।
হ্যাকাররা এরপর সুইফট টার্মিনাল কম্পিউটার থেকে ৩৫টি লেনদেন অনুরোধ পাঠাল, ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার লেনদেন করার জন্য। (চলবে)