মো. গোলাম রহমান
করোনা-পরবর্তীকালে বিশ্বে দ্রুতপরিবর্তন ঘটছে। আর্থিক, সামাজিক, পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা-সব কিছুতেই মানুষ এখন সিকিউরিটি খোঁজে। তবে, পরিবর্তনকে আরো ত্বরান্বিত, সুদৃঢ় করতে আধুনিক দক্ষ জনবল সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষার পাশাপাশি জীবিকার নিশ্চয়তাও চাইছে করোনাকালে চাকরিহারা মানুষ। এই নিশ্চয়তার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেড়ে গেছে ওপেন অ্যান্ড ডিসটেন্স লার্নিংয়ের (ওডিএল) চাহিদা। গত তিন বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ওডিএল শিক্ষার্থী সংখ্যা। যারা এক সময় শিক্ষা বিমুখ ছিলেন, তারাও নিজেদের স্বার্থে এখন শিক্ষামুখী হচ্ছেন। এক্ষেত্রে বয়স বা পেশা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারছে না। ওপেন অ্যান্ড ডিসটেন্স লার্নিংয়ের ওপর তাদের নির্ভরতা বেশি। বর্তমানে বিশ্বে আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ ১০৬টি দেশে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) যে পিছিয়ে আছে, তা বলার অবকাশ নেই।
মিশন অডিট অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে ভারত, পাকিস্তান, চীন, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, কাতার, সৌদি আরব, লিবিয়া, কাতার, দুবাই, তিউনিশিয়া, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ এবং ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে যেতে হয়েছে। গত বছরে ১ লাখ ৮১ হাজার জন শান্তিরক্ষায় মিশনে গিয়েছে। এদের বড় একটি অংশ দূরশিক্ষণ বা বাউবির শিক্ষার্থী। বাউবির তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সেনাবাহিনীর ১৫টি, নৌবাহিনীর চারটি এবং বিমান বাহিনীর দুটি স্টাডি সেন্টারে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত নিশ-১ প্রোগ্রামে ৪০ হাজার ৭২২ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩২ হাজার ৭৪ জন শিক্ষার্থী চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। গড় পাশের হার প্রায় ৮১ শতাংশ। সমরবিদ্যা ও আইসিটি, নৌবাহিনীর জন্য নৌ সমরবিদ্যা, নৌ আইসিটি এবং সামুদ্রিক ভূগোল এবং বিমানবাহিনীর জন্য বিমান সমরবিদ্যা ও আইসিটি (বিমান) বিশেষায়িত কোর্সসমূহ প্রচলিত আছে। উল্লিখিত কোর্সসমূহ ব্যতীত বাকি কোর্সগুলো বাউবির প্রচলিত নিজস্ব কারিকুলাম ও পাঠসামগ্রী দ্বারা পরিচালিত হয়। বাউবির এই পাঠদান পদ্ধতি আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীসহ শান্তিরক্ষীদের করেছে দক্ষ, আত্মমর্যাদাশীল।
৩০ পেরিয়ে সম্প্রতি ৩১ বছরে পা রেখেছে বাউবি। বিশেষ বাহিনীগুলোর সঙ্গে কাজের সমন্বয় করতে গিয়ে দেখেছি মিশন অডিট অধিদপ্তর ওতপ্রোতভাবে এ কাজগুলোর সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফিসের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ অডিট অধিদপ্তরের একটি হলো মিশন অডিট। এই নিরীক্ষা অধিদপ্তর দুটি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত সব বাজেটের (বাজেটারি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট-বিসিজি), সংবিধিবদ্ধ পাবলিক অথরিটি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং পাবলিক এন্টারপ্রাইজের নিরীক্ষা পরিচালনার কাজ করে। যেমন-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, হাইকমিশন, উপ-হাইকমিশন, সহকারী হাইকমিশন, কনস্যুলেট জেনারেল, স্থায়ীমিশন, দূতাবাস, মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স উইং, ফরেন সার্ভিস একাডেমি, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া), জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি), বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) মতো প্রতিষ্ঠানের অডিট করার জন্য এই অধিদপ্তর বিশেষভাবে যুক্ত। ৮৩টি মিশন (ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি হজ মিশনসহ), সোনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের বিদেশস্থ ২৬টি শাখা এবং বিদেশে অবস্থিত ১৭টি বিমান স্টেশন রয়েছে, যা দেশের ভেতরে-বাইরে। বিপরীতে, সারা দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছয়টি ব্যয় কেন্দ্র এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ১২৪টি ব্যয় কেন্দ্র রয়েছে। এই অধিদপ্তরের উদ্দেশ্য হলো রেমিট্যান্স যোদ্ধাসহ আমাদের জনগণের অর্থের মূল্য (ভ্যালু ফর মানি) নিশ্চিত করার জন্য বর্ণিত অফিসগুলোর একটি কার্যকর ও গুণমান সম্পন্ন অডিট পরিচালনা করা এবং স্টকহোল্ডারদের তাদের কার্যক্রমে সেবা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্ভরযোগ্য এবং কার্যকর তথ্যসেবা সরবরাহ করা। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা।
বিশ্বের ১৭২টি দেশে কাজের জন্য যান বাংলাদেশি শ্রমিকরা। প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি শ্রমিক যান বিদেশে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে। মধ্যপ্রাচ্যে বাঙালি শ্রমিকদের জন্য সামনের দিনগুলো খুব চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ, স্বল্পশিক্ষা ও সনদহীন পরিচয় আর অদক্ষতা তাদের বিপদে ফেলছে। তুলনামূলকভাবে ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ অন্যান্য দেশের শ্রমিকের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে আমাদের শ্রমিকদের শ্রম। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অবশ্যই শ্রমিকদের কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে হবে। তাদের জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবার আগে বাড়াতে হবে ভাষা, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষাসনদ ও বাস্তব কাজের জ্ঞানকে। মধ্যপ্রাচ্যে নার্সিং, টেকনিক্যাল জব, গার্মেন্টস, ড্রাইভিং, হ্যাচারি, গার্ডেনিংয়ের চাহিদা প্রচুর। আমাদের দেশ থেকে যে সব শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অদক্ষ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায়; ভবিষ্যতে এদেশের রেমিট্যান্স হুমকির মধ্যে পড়তে পারে-এমন আশঙ্কা অনেকের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতেই পারি, নিশ-১ প্রোগ্রামের মাধ্যমে যেভাবে সফল হয়েছে বাউবি, একই প্রোগ্রাম আমাদের অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য নিড বেইসড্ ডিজাইন করা আবশ্যক। এতে করে বাউবি নিজে এবং আমাদের রেমিট্যান্স ফাইটার সর্বোপরি দেশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। বাউবি বহির্বাংলাদেশে পাঁচটি স্টাডি সেন্টার খুলেছে, এ রকম অন্যান্য দেশেও খোলা উচিত। এক্ষেত্রে বিদেশি দূতাবাস, ফরেন সার্ভিস একাডেমি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ, শিক্ষাবিদ, গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ এগিয়ে আসতে পারেন। শ্রমবাজারকে সমৃদ্ধ করার সুদূর পরিকল্পনা ও মাস্টার রোল প্লে করতে হবে বাউবিকে। আমার বিশ্বাস, বাউবির পক্ষে এটা সম্ভব। কেননা, গত ৩০ বছরে ৮৫টি ফরমাল-ননফরমাল প্রোগ্রাম, দেশব্যাপী জেলা-উপজেলায় বাউবির শিক্ষাক্রম ও দৃশ্যমান কার্যালয়ের মাধ্যমে সেবা দিয়ে আসছে। দক্ষ লোকবলও রয়েছে তাদের। লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রতিষ্ঠার দর্শনে আজ বাউবি প্রায় সফল। একই স্ট্র্যাটেজি মাথায় রেখে বহির্বিশ্বে কাজ করুক বাউবি; যা থেকে আরো গতিশীল হবে আমাদের অর্থনীতি, উপকৃত হবে জাতি, সমৃদ্ধ হবে দেশ।
লেখক: মহাপরিচালক, মিশন অডিট অধিদপ্তর