ড. কানন পুরকায়স্থ
প্রতিবছরের মতো এবারও বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয় গত ২ থেকে ৪ অক্টোবর। গত ২ অক্টোবর ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নোবেল অ্যাসেম্বলি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবরসায়নবিদ ক্যাটালিন ক্যারিকো (Katalin Kariko) ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অনাক্রম্যবিদ (Immunologist) ড্রিউ ওয়াইজম্যানকে (Drew Weissman) ২০২৩ সালের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞান বা শারীরবৃত্তে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্যারিকো ও ওয়াইজম্যান ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা সমানভাবে ভাগ করে নেবেন। উল্লেখ্য, ক্যারিকো ও ওয়াইজম্যান যথাক্রমে হাঙ্গেরি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন।
একটি টিকা নির্দিষ্ট কোনো রোগোৎপাদক জীবাণু থেকে দেহকে রক্ষা করার জন্য দেহের অনাক্রম্যতাকে উদ্দীপিত করে। এভাবে টিকা দেওয়ার কারণে আমাদের শরীর রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। mRNA টিকা একটি নতুন ধরনের টিকা পদ্ধতি। mRNA মানে মেসেঞ্জার রাইবোনিউক্লিয়িক এসিড (এম-আরএনএ)।
এটি নিউক্লিয়িক এসিডের একটি রূপ, যা দেহের কোষগুলোকে বলে যে ডিএনএতে (ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক এসিড) থাকা তথ্যের ভিত্তিতে কী করতে হবে। ডিএনএ প্রতিটি কোষে থাকা জীবনের জন্য একটি নির্দেশিকা ম্যানুয়াল হিসেবে কাজ করে। কিন্তু আরএনএ হলো জেনেটিক কোডের একটি অস্থায়ী অংশ, যা প্রোটিন তৈরি করতে বা এর কোনো ক্ষতি মেরামত করতে সহায়তা করে। জীবরসায়নবিদ ক্যারিকো চিকিৎসাক্ষেত্রে এম-আরএনএ ব্যবহার করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
অন্যদিকে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিকোর গবেষণা সহযোগী ওয়াইজম্যান ডেনড্রাইটিক কোষ নিয়ে কাজ করছিলেন, যে কোষ দেহের অনাক্রম্যতার নজরদারিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে এবং টিকা প্ররোচিত অনাক্রম্যতার প্রতিক্রিয়াকে সক্রিয় করে। যৌথভাবে এই দুই বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন যে নিউক্লিওসাইড ক্ষারের পরিবর্তনের মাধ্যমে এম-আরএনএ জাত প্রোটিন সরবরাহের পরিমাণ অপরিবর্তিত এম-আরএনএর তুলনায় বেশি। এভাবে ক্ষারের পরিবর্তনের মাধ্যমে এম-আরএনএ টিকা আবিষ্কার সহজতর হয়।
গত ৩ অক্টোবর রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান একাডেমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিয়ের অগাস্টিনি, জার্মানির ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট এবং লুডভিগ-ম্যাক্সিমিলিয়ানস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফেরেন্স ক্রাউজ ও সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন লুইলিয়েকে ২০২৩ সালের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একাডেমি তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে যে ‘for experimental methods that generate attosecond pulses of light for the study of electron dynamics in matter’-এর জন্য ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা এই তিন বিজ্ঞানী সমানভাবে ভাগ করে নেবেন।
উল্লেখ্য, অগাস্টিনি, ক্রাউজ ও লুইলিয়ে যথাক্রমে ফ্রান্স, হাঙ্গেরি ও ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৮০-এর দশক থেকে ২০০০ সালের প্রথম দিকে উল্লিখিত তিনজন পদার্থবিজ্ঞানী লেজার স্পন্দন তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা কেবল অ্যাটোসেকেন্ড স্থায়ী হয়। অ্যাটোসেকেন্ড হচ্ছে এক সেকেন্ডের বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১০-১৮ সেকেন্ড। ১৯৮৭ সালে লুইলিয়ে আলোর ‘ওভারটোন’ তৈরি করতে একটি আদর্শ গ্যাসে লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করেন। ১৯৯০-এর দশকে লুইলিয়ে এবং অন্যান্য বিজ্ঞানী ওভারটোন প্রক্রিয়ার কলাকৌশল নিয়ে গবেষণা করেন। উল্লেখ্য, ওভারটোন আলোর তরঙ্গের মতো কাজ করে। ১৯৯৪ সালে অগাস্টিনি RABBIT (Reconstruction of attosecond beating by interference of two photon transitions) নামে পরিচিত একটি স্পন্দন পরিমাপের কৌশল তৈরি করতে শুরু করেন। ২০০১ সালে অগাস্টিনি ২৫০ অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের ধারা (Train) তৈরি করতে সক্ষম হন এবং ক্রাউজ ৬৫০ অ্যাটোসেকেন্ড একক স্পন্দন পৃথক করতে সক্ষম হন। ২০০০ সালের দিকে অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন ব্যবহার করে বিভিন্ন পদার্থে ইলেকট্রনের গতি-প্রকৃতিকে অন্বেষণ করা শুরু হয়। ইভা ওলসন পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান এবং চালমারস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির পদার্থবিদ উল্লেখ করেন, ‘আলোর অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন তৈরি করার ক্ষমতা একটি ক্ষুদ্র-অত্যন্ত ক্ষুদ্র-টাইমস্কেলের দরজা খুলে দিয়েছে। এটি ইলেকট্রনজগতের দরজাও খুলে দিয়েছে।’ নোবেল কমিটির সদস্য ম্যাটস লারসন উল্লেখ করেন যে পদার্থবিজ্ঞানে অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের কৌশল আবিষ্কারের ফলে রসায়নবিজ্ঞানে ‘অ্যাটোকেমিস্ট্রি’ নামে গবেষণার একটি নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হলো। লারসন আরো উল্লেখ করেন যে একটি সেমিকন্ডাক্টরে অ্যাটোসেকেন্ড লেজারের স্পন্দন নিক্ষেপ করলে উপাদানটি প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুতের প্রবাহ সৃষ্টি করবে। এর ফলে ইলেকট্রনিক কৌশলের অতি দ্রুত রূপ উৎপাদন সম্ভব হবে।
গত ৪ অক্টোবর রাজকীয় সুইডিশ বিজ্ঞান একাডেমি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক মঙ্গুই বাওয়েন্ডি, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লুই ব্রাস ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যানোক্রিস্টাল টেকনোলজির প্রধান বিজ্ঞানী আলেক্সাই আকিমভকে ২০২৩ সালের জন্য রসায়নবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একাডেমি তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে যে ‘for the discovery and synthesis of quantum dots’-এর জন্য পুরস্কারের ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা এই তিন বিজ্ঞানী সমানভাবে ভাগ করে নেবেন। উল্লেখ্য, বাওয়েন্ডি, ব্রাস ও আকিমভ যথাক্রমে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। কোয়ান্টাম ডটস বা বিন্দু (dots), যাকে কখনো কৃত্রিম পরমাণু বলা হয়, এক ধরনের ন্যানোক্রিস্টাল, যা সিলিকন ও অন্যান্য সেমিকন্ডাক্টর পদার্থ দিয়ে তৈরি এবং মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার চওড়া ও কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, যদিও তারা আকারে ১০০ থেকে কয়েক হাজার পরমাণুর সমষ্টি। যেহেতু ইলেকট্রনগুলো তাদের মধ্যে নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে আটকে থাকতে পারে, তাই ন্যানোক্রিস্টালগুলো শুধু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো নির্গত করতে পারে। গবেষকরা কোনো কণার আকার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উদ্দীপিত কোয়ান্টাম বিন্দুগুলো কী রঙের আলোর ঝলক সৃষ্টি করবে, তা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন।
এই গবেষণাটি ১৯৪৭ সালে শুরু হয়েছিল, যখন জন বারডিন, উইলিয়াম শকলি ও ওয়াল্টার ব্র্যাটেন সেমিকন্ডাক্টর ট্রানজিস্টর আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে জ্যাক কিলবি প্রথম ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট তৈরি করেন। ১৯৮১ সালে আলেক্সি আকিমভ সেমিকন্ডাক্টিং ন্যানোক্রিস্টালের বিশেষ অপটিক্যাল বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেন। ১৯৮৩ সালে লুই ব্রাস কলয়েডাল সেমিকন্ডাক্টর ন্যানোক্রিস্টাল আবিষ্কার করেন। ১৯৮৬ সালে মার্ক রিড ন্যানোক্রিস্টালের মতো ক্ষুদ্র বস্তুকে বর্ণনা করার জন্য ‘কোয়ান্টাম ডটস’ নামটি প্রবর্তন করেন। ১৯৯৩ সালে মঙ্গুই বাওয়েন্ডি পছন্দসই নির্দিষ্ট আকারের ন্যানোক্রিস্টাল সংশ্লেষণের জন্য একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ১৯৯৫ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য কোয়ান্টাম ডটসকে বিভিন্ন উপাদানে একীকরণে সক্ষম হন।
এ বছরের নোবেল পুরস্কার স্বীকৃত আবিষ্কার কিভাবে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা হচ্ছে? চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার স্বীকৃত আবিষ্কার এরই মধ্যে লাখ লাখ জীবন বাঁচিয়েছে। ক্যারিকো ও ওয়াইজম্যানের আবিষ্কার যে নিউক্লিওসাইড ক্ষার পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া হ্রাস হতে পারে এবং প্রোটিন উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে, তা এম-আরএনএর ক্লিনিক্যাল ব্যবহারের পথে বাধাগুলোকে সরিয়ে দিয়েছে। কভিড-১৯ মহামারি প্রাদুর্ভাবের পরে দুটি নিউক্লিওসাইড ক্ষার-সংশোধিত এম-আরএনএ টিকা তৈরি করা হয়েছিল এবং SARS-Cov-2 ভাইরাসে সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এই ক্ষার পরিবর্তন কৌশলটি আরো বিভিন্নক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া এই কৌশল ব্যবহার করে অন্যান্য রোগের জন্য টিকা তৈরি করাও সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার স্বীকৃত আবিষ্কার এরই মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন পদার্থের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া পরীক্ষা করতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইলেকট্রনিকস থেকে ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে এর সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে চলছে নানা গবেষণা। ফেরেন্স ক্রাউজ রক্তের কোষে সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো শনাক্ত করতে অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন ব্যবহার করেছেন, যার মাধ্যমে ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
রসায়নবিজ্ঞানে এ বছরের নোবেল পুরস্কার স্বীকৃত আবিষ্কার কোয়ান্টাম ডটস এরই মধ্যে ইলেকট্রনিকস ও বায়োমেডিসিনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে; যেমন-ড্রাগ ডেলিভারি, ইমেজিং এবং রোগ নির্ণয়ে। চিকিৎসকরা শরীরের টিউমার টিস্যু পর্যবেক্ষণ করতে কোয়ান্টাম ডটসের ব্যবহার শুরু করেছেন। অনেক রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে, যেখানে কোয়ান্টাম ডটস অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে ভবিষ্যতে ইলেকট্রনিকস, ক্ষুদ্র সেন্সর, সৌরকোষ এবং কোয়ান্টাম যোগাযোগের সাংকেতিকীকরণে এই পদ্ধতি অবদান রাখবে।
সর্বোপরি আলফ্রেড নোবেল তাঁর উইলে উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি তাঁদের পুরস্কার দিতে চান, যাঁদের আবিষ্কার মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী হবে এবং বিশ্বের সব অঞ্চলের বিজ্ঞানীরা এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন। এ বছর নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচন অন্যান্য বছরের চেয়ে আলাদা নয়। এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন একজন রাশিয়ান বিজ্ঞানী। ভূ-রাজনীতি পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে নোবেল কমিটিকে প্রভাবিত করেনি। এ বছরের নোবেল পুরস্কার স্বীকৃত গবেষণা; যেমন-কোয়ান্টাম ডটস, অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দন ও এম-আরএনএ টিকা আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষে মানবজাতিকে উপকৃত করেছে এবং এই আবিষ্কারগুলো আগামী দিনেও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনবে।
লেখক : যুক্তরাজ্যে কর্মরত গবেষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা ও অধ্যাপক