মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ: বাংলাদেশ একটি জনবহুল ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ বাঙালি ও মুসলমান। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ ৮৭ হাজার; সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ১ শতাংশের মতো (১.১১%)। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেশিরভাগ পার্বত্য চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী অঞ্চলে বসবাস করে।
এ দেশের উপজাতিদের ধর্মবিশ্বাস হলো-
চাকমা: বেশিরভাগ চাকমা পুরনো থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করে। তাদের বৌদ্ধ ধর্ম পালনের মধ্যে সনাতন ধর্ম ও অন্যান্য প্রাচীন ধর্মের মিল রয়েছে। আগে চাকমারা হিন্দু দেব-দেবীর পূজাও করত। চাকমারা ভূত-প্রেত বিশ্বাস করে এবং তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য ছাগল, মুরগি, হাঁস ইত্যাদি বলি দেওয়ার প্রচলন ছিল। যদিও বৌদ্ধ বিশ্বাসমতে পশু বলি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের নবজাগরণকারী বৌদ্ধভিক্ষু পরম পূজ্য সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভন্তের অক্লান্ত পরিশ্রমে এসব কুসংস্কার বর্তমানে প্রায় নেই বললেই চলে।
মারমা: মারমারাও জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এবং নববর্ষ উপলক্ষে নানা রকমের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উৎসব হচ্ছে- বুদ্ধপূর্ণিমা, কঠিন চীবর দান, ওয়াংগ্রাই বা প্রবারণা পূর্ণিমা, সাংগ্রাই ইত্যাদি।
সাঁওতাল: সাঁওতালদের মধ্যে সনাতন ধর্ম (৬৩%), সরনা ধর্ম (৩১%), খ্রিষ্টধর্ম (৫%) ও অন্যান্য (১%)। সাঁওতালি ভাষায় দেবতাকে বলে ‘বোংগা’। এদের প্রধান দেবতা হচ্ছে চান্দোবোংগা (সূর্যদেব)। সাঁওতালদের গৃহদেবতার নাম ‘আবগে বোংগা’। সাঁওতালরা বিভিন্ন পূজা-পার্বণ ও সামাজিক উৎসবে নাচ-গানে মেতে ওঠে। শীতের শেষে যখন বনে ফুল ফোটে তখন এরা বাহা উৎসব উদযাপন করে। দুর্গাপূজায় সাঁওতালরা একটি বিশেষ নাচের উৎসবে মেতে ওঠে, যা সাঁওতালি ভাষায় দাসাই নামে পরিচিত।
ত্রিপুরী: ত্রিপুরীদের মধ্যে সনাতন ধর্ম (৯৩.৬%), খ্রিষ্ট ধর্ম (৬.৪%)। ত্রিপুরীদের ৯৩.৬০% ত্রিপুরী লোক হিন্দুসিম এবং ত্রিপুরী লোকধর্মের সংমিশ্রণ অনুসরণ করে এবং ৬.৪% ত্রিপুরী জনগণ খ্রিস্টান (বেশিরভাগ ব্যাপ্টিস্ট)। ত্রিপুরীর উচাই গোষ্ঠীতে রয়েছে কিছু বৌদ্ধ।
গারো: গারোরা প্রধানত খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারী। তাদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মের নাম সংসারেক, যা ‘প্রকৃতি পূজার’ ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। গারোরা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতোও পূজা করে থাকে। এদের প্রধান দেবতার নাম ‘তাতারা রাবুগা’। গারোরা ধর্ম প্রধানকে ‘কামাল’ বলে। মিসি সালজং (ঝধষলড়হম) তাদের উর্বরতার দেবতা এবং সূর্য সালজংয়ের প্রতিনিধি। ফসলের ভালোমন্দ এই দেবতার ওপর নির্ভর করে বলে তাদের বিশ্বাস। গোয়েরা (এড়বৎধ) গারোদের শক্তি দেবতার নাম। মাটিকে গারোরা আমা অর্থাৎ ‘মা’ হিসেবে অভিহিত করে। গারোদের বিশ্বাস মৃত্যুর পরে আত্মা ‘চিকমাং’ অর্থাৎ বর্তমান কৈলাশ পর্বত যায়।
কোচ: কোচরা একদিকে যেমন দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতীপূজা, লক্ষীপূজা সম্পন্ন করে, তেমনি তাদের নিজস্ব পুরোহিত তথা দেউসি ও আজেং দ্বারা আদি ধর্মের দেব-দেবী, ঋষি এবং তার পত্মী যোগমায়ার পূজা করে। কোচেরা এই দুজনকেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করে। দেবী কামাখ্যাও কোচ সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান দেবী।
হাজং: হাজংরা পুরোপুরিভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বী। জন্মের সময় থেকেই সব হিন্দু রীতিনীতি হাজংরা মেনে চলে। হিন্দু বিশ্বাসগুলো তাদের মূল সংস্কৃতির সঙ্গে মেশা এবং তাদের আলাদা করা অসম্ভব। হাজংদের দ্বারা চর্চা করা বর্তমান ধর্মীয় রীতিগুলোকে তাদের লোকধর্ম এবং সনাতন ধর্মের সংমিশ্রণ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
খাসিয়া বা খাসি: জনসংখ্যা খাসিয়া বা খাসিদের ধর্মবিশ্বাসের পরিসংখ্যান হলো- খ্রিস্টান ৮৩.১৪% , নিয়াম খাসি ১৫.৪১% , হিন্দু ০.৭৩% , বৌদ্ধ ০.১২%, মুসলমান ০.১১% ও নাস্তিক ০.৪৯%। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের আগমনের আগে এবং ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে, প্রায় সব খাসিয়া বা খাসি মানুষই একটি প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম পালন করত।
পাঙাল: বাংলাদেশের পাঙালরাই একক জনগোষ্ঠী, যারা বিশ্বাসে মুসলমান হলেও পরিচিতিতে আদিবাসী। বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন কর্তৃক ২০১৯ সালের শুমারি অনুযায়ী, পাঙালের জনসংখ্যা ১০ হাজার ৯৪৭ জন। যার মধ্যে পুরুষ পাঁচ হাজার ৬৩৮ জন এবং নারী পাঁচ হাজার ৩০৯ জন।