পূর্ব প্রকাশিতের পর
ড. আতিউর রহমান: ১৯০৫ সালে কৃষি সমবায় ব্যাংক স্থাপন করে গরিব চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করে কৃষি বিপ্ল¬ব ঘটিয়ে মহাজনদের দাসত্ব ও গোলামির জিঞ্জির থেকে তাদের মুক্ত করার যে প্রয়াস পেয়েছিলেন তা তো তৎকালীন ভারতের বিরল ঘটনাই বলা যায়। আধুনিক চাষাবাদ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, খামার ব্যবস্থাপনা, হস্ত ও কুটিরশিল্প, তাঁত শিল্প, রেশম শিল্পের বিকাশ ঘটানো, ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যে ঋণ কর্মসূচি তিনি হাতে নিয়েছিলেন তার সুদূরপ্রসারি প্রভাব পড়েছিল ওই এলাকায়। তিনি পুত্র ও জামাতাকে কৃষিতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাননি। তাদের ব্যারিস্টার বানাতেও চাননি।
চিঠিতে তাদের তিনি লিখেছিলেন “তোমরা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজার অন্ন গ্রাসের অংশ নিয়ে বিদেশে কৃষি শিখতে গেছ। ফিরে এসে এই হতভাগ্যদের অন্ন গ্রাস কিছু পরিমাণেও যদি বাড়িয়ে দিতে পার তাহলে মনে শান্তনা পাব। মনে রেখো জমিদারের টাকা চাষির টাকা এবং এই চাষিরাই তোমাদের শিক্ষার ব্যয়ভার নিজেরা আধপেটা খেয়ে এবং না খেয়ে বহন করছে। এদের ঋণ সম্পূর্ণ শোধ করবার দায় তোমাদের উপর রইল। নিজেদের সংসারিক উন্নতির চেয়েও এইটেই তোমাদের প্রথম কর্তব্য হবে” (চিঠিপত্র ১৯ পৃ. ১১১)। এ কথাগুলো থেকেই অনুভব করা যায় কী গভীর ছিল প্রান্তজনের প্রতি তার দায়। কালীগ্রামের এসব কর্মযজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ কতটা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন তা কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আলোচনা থেকে অনুমান করা যায়। “সেবার পতিসরে পৌঁছে গ্রামবাসীদের অবস্থার উন্নতি দেখে মন পুলকিত হয়ে উঠলো। পতিসরের হাইস্কুলে ছাত্র আর ধরছেনা। দেখলুম-নৌকার পর নৌকা নাবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ছেলের দল স্কুলের ঘাটে। এমনকি, আট-দশ মাইল দূরের গ্রাম থেকেও ছাত্র আসছে। পড়াশুনার ব্যবস্থা প্রথম শ্রেণীর কোন ইস্কুলের চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। পাঠশালা, মাইনর স্কুল সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। হাসপাতাল ও ডিসস্পেনসারিতে কাজ ভালো চলছে। যে সব জোলা আগে এক সময় গামছা বুনতো তাঁরা এখন ধুতি, শাড়ী, বিছানার চাদর বুনতে পারছে। কুমোরদেরও কাজের উন্নতি হয়েছে। গ্রামবাসীর আর্থিক দুরবস্থা আর নেই। শুধু চাষীরা অনুযোগ জানালো তাদেরকে চাষের জন্য আরও ট্রাক্টর এনে দেওয়ার জন্য” (রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পিতৃস্মৃতি’)। কৃষির এই রূপান্তরের পরম্পরা আমাদের আজকের কৃষিব্যবস্থায় দেখে সত্যি অবাক হতে হয়।
পতিসর থেকে লব্ধ উপলব্ধির আলোকে গ্রামবাসীদের ঐক্যবদ্ধ রাখার পক্ষে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “মনের মাঝে উৎকণ্ঠা নিয়ে আজ এসেছি গ্রামবাসী তোমাদের কাছে। পূর্বে তোমরা সমাজবন্ধনে এক ছিলে, আজ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পরকে কেবল আঘাত করছ। আর-একবার সম্মিলিত হয়ে তোমাদের শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। বাহিরের আনুকূল্যের অপেক্ষা করো না। শক্তি তোমাদের মধ্যে আছে জেনেই সেই শক্তির আত্মবিস্মৃতি আমরা ঘোচাতে ইচ্ছা করেছি। …আর-সকল দেশ এগিয়ে চলেছে, আমরা অজ্ঞানে অশিক্ষায় স্থাবর হয়ে পড়ে আছি। এ সমস্তই দূর হয়ে যাবে যদি নিজের শক্তি সম্বলকে সমবেত করতে পারি। আমাদের এই শ্রীনিকেতনে জনসাধারণের সেই শক্তি সমবায়ের সাধনা।” (‘গ্রামবাসীদিগের প্রতি’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, রর, দশম খণ্ড, পৃ. ৬০৯)। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরশ পল্লিবাসীর পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সে কারণে নগরবাসীরও রয়েছে দায়। দেশে জন্মালেই যে দেশ আপন হয় না সে কথা তিনি তাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। “যতক্ষণ দেশকে না জানি, যতক্ষণ তাকে নিজের শক্তিতে জয় না করি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়।” (‘দেশের কাজ’, রর, চতুর্দশ খণ্ড, পৃ. ৩৬৮)।
তিনি মনে করতেন জীবন আর শিক্ষা গায়ে গা লাগানো দুটো বিষয়। তাই জীবনধর্মী শিক্ষার পক্ষে তিনি সারা জীবন লিখেছেন এবং কাজ করেছেন। স্বীকার করতেই হবে আমাদের জ্ঞানের ভান্ডারে সবচেয়ে মূল্যবান রতœটির নাম রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সমাজ চিন্তা ও সমাজ ভাবনায় ‘পতিসর’ নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘পতিসরে’র সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও অনেক বেশি। আসলেই রবীন্দ্রনাথের পতিসর বাঙালির মনোজগতে এক নতুন সত্ত্বা হিসাবে আবির্ভূত হতে পেরেছে। আগের পতিসর আর রবীন্দ্র-উত্তর পতিসরের মাঝে তাই তফাৎ চোখে পড়ার মতো। তাই তো রবীন্দ্রনাথের পতিসর অনন্য। অসামান্য। নতুন প্রজন্মকে ‘রবিতীর্থ’ পতিসরসহ রবীন্দ্রনাথের আরও স্মৃতিবিজড়িত যেসব জায়গা রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে বিষদ জানানোর প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যত বেশি আলাপ-আলোচনায় ‘পতিসর’কে আনতে পারব তত বেশি এ জায়গাটি সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে। বলার অপেক্ষা রাখে না রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে পতিসর জায়গা করে নেওয়ার কারণেই তা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে। আর তার অনেক প্রমাণ প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হচ্ছে। আমরা তাই বারবার ফিরে যাই রবীন্দ্রনাথের প্রাণের পতিসরের কাছে। এ যাত্রা নিরবচ্ছিন্ন থাকুক সেই প্রত্যাশাই করছি।