প্রাচীন ও আধুনিক যুগে জাহিলিয়াত

প্রাচীন ও আধুনিক যুগে জাহিলিয়াত

হাবিব মুহাম্মাদ
‘জাহিলিয়াত, জাহিলি যুগ ও জাহিলি সমাজ’ শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা পরিচিত। নিজেরাও খারাপ উপমা দেওয়ার ক্ষেত্রে শব্দগুলো ব্যবহার করি। শব্দগুলো শোনামাত্র মূর্খ, উদাসীন, অন্ধকার, বর্বর, পাশবিক একটি জাতি ও সমাজের চিত্র আমাদের মাথায় চলে আসে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি; ঠিক কী অপরাধের কারণে তারা ইতিহাসে এমন ঘৃণিত নামে আখ্যায়িত হয়েছে? যদি কোরআন-সুন্নাহ ও ইতিহাসের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে যে অপরাধের কারণে তাদের এমন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, সেই অপরাধগুলো আমাদের সমাজেও বিদ্যমান।
অথচ আমরা তাদের বর্বর ও জাহিলি জাতি বললেও নিজেদের সভ্য জাতি বলে দাবি করি! অপরাধী হয়েও যার অপরাধবোধ নেই, সে কখনো পরিশুদ্ধ হতে পারে না; বরং আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। একই অপরাধের কারণে সেই সমাজ জাহিলি হলে এই সমাজকেও জাহিলি সমাজ বলতে হবে। সেটা প্রাচীন জাহিলিয়াত আর বর্তমান হলো আধুনিক জাহিলিয়াত।
জাহিলি যুগের প্রধান অপরাধ ছিল শিরক ও পৌত্তলিকতা।
এমনকি তারা পবিত্র কাবাঘরে পর্যন্ত মূর্তি স্থাপনে দ্বিধা করেনি। নিজেদের হাতে তৈরি অক্ষম মূর্তিকে তারা সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার আসনে আসীন করেছিল। এক্ষেত্রে তাদের প্রধান যুক্তি ছিল বাপ-দাদার প্রাচীন ধর্ম। আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করলেও তারা খোদাপ্রদত্ত ধর্ম ছেড়ে হয়ে পড়েছে প্রবৃত্তিপূজারী।
আমরাও সামগ্রিকভাবে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য শিরকে লিপ্ত। তাদের মতো আমরাও আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা স্বীকার করলেও জীবনের বাস্তবতায় তা কর্যকর করি না। ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদ হয়ে পড়েছে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। কোরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন স্বীকার করি। ক্ষমতা, অর্থ এবং ব্যক্তি ও দলকে প্রাধান্য দিই।
জাহিলি যুগের দ্বিতীয় অপরাধ ছিল নারীদের নিছক উপভোগের পণ্য মনে করা হতো। ছিল না তাদের সামাজিক কোনো অধিকার। তাদের উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হতো। বরং তাদের নিজেদেরও উত্তরাধিকার সম্পদ গণ্য করে পুরুষদের মাঝে বণ্টন করা হতো। তাদের অবহেলিত ও বোঝা মনে করা হতো। একপর্যায়ে নারীরা এতই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হলো যে কন্যাসন্তানের সংবাদ শুনলে ভ্রুকুঞ্চিত করা হতো। এমনকি জীবন্ত কন্যাশিশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। আমাদের সমাজেও নারীদের ভোগের পণ্য হিসেবে পরিবেশন করার নজির আছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের বিচরণ বাড়লেও বাড়েনি তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা; বরং বেড়েছে নারী নির্যাতন। বঞ্চিত করা হয় তাদের উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে। কন্যাসন্তানের তুলনায় পুত্রসন্তানে বেশি সন্তুষ্ট হয়। কন্যাদের তুলনায় ছেলেদের আলাদা যতœ ও কদর করা হয়।
জাহিলিদের তৃতীয় অপরাধ ছিল সুদ। তাদের সমাজে সুদ ছিল সর্বজন স্বীকৃত। সবাই ছিল সুদের সঙ্গে জড়িত। এমনকি তারা সুদ ও ব্যবসার মধ্যে কোনো পার্থক্য করত না। তারা বলত ব্যবসা ও সুদ একই জিনিস। অথচ সুদ আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের শামিল। অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী। বর্তমান সমাজে আমরা সুদের সঙ্গে জড়িত।
জাহিলিদের চতুর্থ অপরাধ ছিল অহমিকা, গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতা। পান থেকে চুন খসলে তারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হতো। ছোটো ও তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে তারা বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। এ ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করার ন্যায়-অন্যায়ের মানদন্ড ছিল না; বরং অপরাধী হলেও প্রত্যেকেই আপন মিত্রকে সহযোগিতা করত। পরস্পর সহযোগিতার মানদন্ড ছিল শত্রু-মিত্র। আমাদের সমাজেও অহমিকা, গোঁড়ামি ও নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য তুচ্ছ বিষয়ে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দেশ পরস্পর রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এমনকি নিরীহ মানুষ হত্যা মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অপরাধী হলেও প্রত্যেকে আপন মিত্রকে সাহায্য করছে। নৃশংসভাবে হত্যাকান্ড বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাহিলি যুগের পঞ্চম অপরাধ ছিল মদাসক্তি। মদ ছিল তাদের অন্যতম পানীয় আর পানশালা ছিল তাদের অতি প্রিয়। তাতে ছিল দিন-রাত তাদের আনাগোনা। প্রতি ঘরে ঘরে তৈরি হতো মদ। আধুনিক যুগেও মদের আসক্তি আছে। মদের বারগুলো উন্মুক্ত এবং তা এখন সহজলভ্য। রাজা থেকে প্রজা-সবাই তার নিয়ামক। মদের পাশাপাশি তাদের আরেকটি অপরাধ ছিল জুয়ার আসর। জুয়ায় সব সম্পদ নিঃস্ব হয়ে গেলে তারা নিজের স্ত্রীকেও নিলামে উঠাত। আধুনিক সমাজে ক্যাসিনোর গ্রাহকের সংখ্যা অনেক। জাতীয় খেলাধুলাসহ বিভিন্নভাবে আমরা জুয়ায় জড়িত।
জাহিলিদের ষষ্ঠ অপরাধ ছিল ব্যভিচার। নারীদের অশালীন পোশাকে অবাধ বিচরণ ও মেলামেশা। বিবাহ-বহির্ভূত নারী সম্ভোগ তাদের কাছে দোষের ছিল না। ছিল পেশাদার নারীদের দেহ ব্যবসা। আধুনিক সমাজে নারীদের অশালীন পোশাকে অবাধ বিচরণ ও মেলামেশা একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আছে লিভ টুগেদার ও ব্যভিচার। পেশাদার নারীদের দেহ-ব্যবসা।
জাহিলিদের সপ্তম অপরাধ ছিল দুর্বলের প্রতি সবলের আধিপত্য। ধনী-গরিব বৈষম্য। সম্মান ও মর্যাদার মানদণ্ড ছিল অর্থ ও ক্ষমতা। ক্ষমতাবান ও ধনীরাই হতো সমাজের নেতৃত্বদানকারী। দুর্বল ও অসচ্ছলরা ছিল নির্যাতিত ও অবহেলিত। বর্তমান সমাজেও জোর যার মুলুক তার নীতি বিদ্যমান। অযোগ্য ও অপরাধী হলেও অর্থ ও ক্ষমতার কারণে তারাই হয় নেতৃত্বদানকারী। ফলে রক্ষক হয় ভক্ষক।
এ ছাড়া জাহিলিদের মধ্যে জীবিকার স্বল্পতা, লোভ-লালসা হিংসা ও জীবনের মূল্যহীনতার দরুণ তাদের মাঝে আত্মসাৎ, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ, খুনখারাবি, লুটতরাজ ও হানাহানিসহ নানা অপরাধ বিদ্যমান ছিল। যার সবগুলো অপরাধ আমাদের সমাজেও বিদ্যমান। তাই কোনোভাবেই এটাকে সুস্থ ও সভ্য সমাজ বলা যায় না। কোরআনের নুর তাঁদের এই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেছে। অসভ্য জাতি থেকে সভ্য ও আদর্শ জাতিতে রূপান্তরিত করেছে। আমাদেরও একই আলোয় আলোকিত হতে হবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *