জিন্নাতুন নূর: তিন বছরের সিফাতমাত্র কথা বলতে শিখেছে। শিশুটির অভিভাবকরা সিফাতকে অনেক খেলনা কিনে দিলেও সে তার মায়ের মোবাইল ডিভাইসটিতে ভিডিও গেম খেলতে এবং ইউটিউবে ভৌতিক কার্টুন দেখতে পছন্দ করে। মোবাইল কেড়ে নিলেই চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এমনকি তার মা-বাবাকে হাত দিয়ে মারতে চায়। খাবার সময় মোবাইল হাতে না দিলে শিশুটি খেতে পর্যন্তচায় না। ইউটিউবে সহিংস কার্টুন দেখে সিফাত এখন অন্যদের সঙ্গেও সহিংস আচরণ করে। শিশুটির অবস্থা দেখে চিন্তিত তার মা-বাবা। আলিফ হোসেইন (৯) রাজধানীর একটি ইংরেজি ভার্সন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। দুই-তিন বছর থেকেই মা-বাবার মোবাইল ডিভাইসের প্রতি ঝোঁক তার। মোবাইলে ‘মাইন্ডক্রাফট’সহ বিভিন্ন খেলায় আসক্ত সে। আলিফের মা নুসরাত আক্তার বুঝতে পারছেন যে ছেলের বয়স যত বাড়ছে মোবাইল ডিভাইসের প্রতি আসক্তিও বেড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ডিভাইসে তাকিয়ে থেকে শিশুটির চোখেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শে চশমা দিতে হয়েছে আলিফকে। অন্য শিশুদের তুলনায় শিশুটি কথা কম বলে। সহজে কারও সঙ্গে মিশতেও চায় না। যে বয়সে এই শিশুদের মাঠে খেলে বেড়ানোর কথা, ঘরে খেলনা দিয়ে খেলার কথা, গল্পের বই পড়ার কথা এবং রংপেনসিল দিয়ে ছবি আঁকার কথা সে বয়সেই এর কোনোকিছুতেই এই শিশুদের আগ্রহ নেই। এই দুই শিশুর মতোই নগরীর অসংখ্য শিশুর শৈশব কেড়ে নিচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইস। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তাদের বুদ্ধির বিকাশ সাধারণ শিশুদের চেয়ে কম। এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ শিশু শরীর চর্চার পেছনে দৈনিক এক ঘণ্টা সময় ও ব্যয় করে না। অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন শিশু শরীরচর্চার পেছনে সময় ব্যয় করে না।
চক্ষু ও মানসিক রোগবিশেষজ্ঞরা জানান, মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের মতো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির কারণে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাধা পাচ্ছে মানসিক বিকাশ। এর কারণে এখন ছয় থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের দৃষ্টি ও মানসিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে দেখা যাচ্ছে। যে শিশুরা এখন মানসিক সমস্যায় ভুগছে এর পেছনে অন্যতম কারণ মোবাইল আসক্তি। আর শিশুর ক্ষীণদৃষ্টির অন্যতম কারণও মোবাইলসহ ইলেকট্রনিক্স পণ্যের আসক্তি।
করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এবং বাইরে খেলার সুযোগ না থাকায় বেশিরভাগ স্কুল পড়ুয়া শিশু ঘরে থেকে মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস বেশি ব্যবহার করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবার খুলে গেলেও কার্টুন দেখা, গেমসখেলা ও মুভি দেখার মতো বিনোদনমূলক কাজগুলো শিশুরা এখনো মোবাইলেই বেশি করছে। কিন্তু মোবাইল স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকার ফলে শিশুর দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্তহচ্ছে। এছাড়া শহরে খেলার মাঠের অভাব, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণে ঘরের বাইরে নিরাপত্তা কম থাকায় শিশুরাও ঘরের বাইরে গিয়ে সেভাবে খেলতে পারছে না।
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মো. জাফরুল হাসান বলেন, আমাদের কাছে অভিভাবকরা যে শিশুদের নিয়ে আসছে তাদের অনেকেরই দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে পড়ায় তারা চোখে কম দেখছে। অতিরিক্ত মোবাইল ফোন আসক্তির জন্যই এমনটি হয়েছে। এজন্য অভিভাবকদের আমরা শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের জন্য নিরুৎসাহিত করছি। আর তা না হলে চোখের মাইনাস পাওয়ার আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, দীর্ঘসময় মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারে শিশুর নিয়ার ভিশন-এর দূরত্ব কমে যায়। শিশুর দৃষ্টি তখন মাইনাসের দিকে চলে যায়। মোবাইল ব্যবহারে বর্তমানে অনেক শিশুর দৃষ্টি মাইনাসে চলে যাচ্ছে। এছাড়া মোবাইল রশ্মি ও দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি করছে। মোবাইল ব্যবহারের সময় একটি দিকেই বেশি মনোযোগ দেওয়ায় এবং অন্য শারীরিক কসরত কমে যাওয়ায় শিশুর মেজাজও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের সভাপতি ও স্কয়ার হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বলেন, মোবাইলসহ অন্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের আসক্তির ফলে শিশুর ক্ষতি ভয়ংকর পর্যায়ে চলে গেছে। এই সমস্যায় পড়ে প্রচুর অভিভাবক নিজের সন্তানকে চিকিৎসার জন্য আনছেন। ছোট শিশু থেকে শুরু করে শিশু-কিশোররাও এসব ডিভাইসে আসক্ত। এর ফলে শিশুরা লেখাপড়া বিমুখ হয়ে পড়ছে। অসামাজিক হয়ে পড়ছে। সর্বোপরি তাদের ব্যক্তিত্বে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে এবং তাদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। পরে এধরনের শিশুর বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতায় আক্রান্তের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। তার মতে, এ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানকে কতটা সময় এ ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করতে দেবেন তা ঠিক করতে হবে। সন্তান বায়না করলেও তাকে মোবাইলসহ অন্য ডিভাইস ব্যবহার করতে না দিয়ে বিকল্পব্যবস্থায় যেতে হবে।