অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান মিয়া: মানুষ সামাজিক জীব। একাকী বসবাস করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, বিধায় তারা গড়ে তুলেছে সমাজ ব্যবস্থা। আমাদের বাড়ির চারপাশে যারা বসবাস করে, মূলত তারাই আমাদের প্রতিবেশী। ইসলামে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। হযরত রাসুল (সা.) বলেন- ‘‘আল মুসলিমু মান সালিমাল মুসলিমুনা মিল লিসানিহী ওয়া ইয়াদিহী।’’ অর্থাৎ- “মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার মুখ এবং হাত দ্বারা অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে।” (বোখারী শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬) কোন ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান সে সম্পর্কে আল্লাহ্র প্রিয় বন্ধু হযরত রাসুল (সা.) পূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। বর্তমানে আমাদের সমাজের দিকে তাকালে ইসলামের বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। প্রতিবেশীর সাথে উত্তম ব্যবহার করার এবং সৎভাব রক্ষা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। অথচ আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিবেশীর সাথে দ্ব›দ্ব-কলহ, এমনকি মামলা মোকাদ্দমা পর্যন্ত করে থাকি। যাতে বন্ধুত্বের পরিবর্তে শত্রæতা সৃষ্টি হয়। প্রতিবেশীর সাথে শত্রæতা পোষণকারীদের সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “হযরত আবু শুয়ারাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত। নবি (সা.) একদা বলেছিলেন, আল্লাহ্র কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহ্র কসম! সে লোক মু’মিন নয়। আল্লাহ্র কসম! সে লোক মু’মিন নয়। জিজ্ঞাসা করা হলো: ইয়া রাসুলাল্লাহ! কে সে লোক? তিনি বললেন- যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না।” (বোখারী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৮৯, ই.ফা.বা. কতৃক অনূদিত বোখারী শরীফ ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৯ ও ৪১০) প্রতিবেশীকে নিরাপদ রাখার অর্থ হচ্ছে তার সাথে সদ্ভাব রক্ষা করা। অথচ আমরা প্রতিবেশীর সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত উদাসীন থাকি। এমনকি প্রতিবেশী খেয়ে আছে না উপবাসে রয়েছে, সেই খবরটুকু পর্যন্ত আমরা নিতে চাই না। যেটা চরম অন্যায়। হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “আমার উপর সেই ব্যক্তির বিশ^াস নেই, যে পূর্ণপেট আহার করে রাত্রিযাপন করে, আর তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে।” অন্যত্র হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “আতিয়্যা ইব্ন আমির জুহানী (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সালমা (রা.)-এর নিকট শুনেছি যে, তাঁকে আহার করতে পীড়াপীড়ি করা হলে তিনি বলতেন, আমার জন্য যথেষ্ট। আমি রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, দুনিয়াতে যেসব লোক পেশ পুরে খায়, তারাই কিয়ামতের দিন অধিক ক্ষুধার্ত থাকবে। (ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত; সুনানে ইবনে মাজাহ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৪-২২৫)
হযরত আবুজর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, “হে আবুজর! যখন তুমি তরকারী রান্না করবে, তখন তাতে একটু বেশি পানি দাও এবং তোমার পড়শির খোঁজখবর নাও।” (মুসলিম শরীফের সূত্রে রিয়াদুস সালেহীন ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮১) এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, প্রতিবেশীর সাথে সকল রকমের সুসম্পর্ক বজায় রাখা আমাদের একান্ত জরুরি। প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা বেশি কাছের, তাদের প্রতি দায়িত্বও বেশি। প্রতিবেশী শুধু মুসলমান হবে- এমন নয়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিও প্রতিবেশী হতে পারে। হযরত রাসুল (সা.) বলেন, প্রতিবেশীদের প্রতি আমাদের যথেষ্ট কর্তব্য রয়েছে। একজন মুসলমান প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য রয়েছে দুই দিক থেকে। প্রথমত মুসলমান হিসাবে, আর দ্বিতীয়ত প্রতিবেশী হিসেবে। অপরদিকে, একজন অমুসলমান প্রতিবেশীর অধিকার একপ্রকার। আর তা হচ্ছে প্রতিবেশী হিসেবে।
আমরা প্রতিবেশীর প্রতি অত্যন্ত উদাসীন থাকি। হয়ত দেখা যায় প্রতিবেশী না খেয়ে অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, অপরদিকে আমরা পেটপুরে আহার করছি। এমনকি তাদের কষ্টে বিন্দুমাত্র দুঃখিতও হই না। এটা চরম অন্যায়। আল্লাহ্ বলেন, হে বিশ্বাসীরা! তোমরা যা উপার্জন করেছ, তা থেকে আল্লাহ্র পথে ব্যয় করো। আল্লাহ্র পথে ব্যয় করা অর্থ হচ্ছে- অসহায়, গরিব-দুঃখীদের দান করা। অথচ আমরা তা করতে তেমন একটা আগ্রহী হই না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ ফরমান- “আর তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক।” (সূরা যারিয়াত ৫১: আয়াত ১৯) সুতরাং অসহায় ও দরিদ্র ব্যক্তিদের দান করা তাদের প্রতি ধনীদের কোনো অনুগ্রহ নয়, বরং এটা তাদের প্রাপ্য অধিকার। মহান আল্লাহ্ কালামে পাকে এরশাদ করেন, যারা গরিব মিসকিনদের খাদ্য দান করে না, তাদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। পক্ষান্তরে যারা অসহায় ও দরিদ্র প্রতিবেশীকে সাহায্য করে, আল্লাহ্ তাদেরকে বিশেষ দয়া ও রহমত দান করে থাকেন। দরিদ্র প্রতিবেশীকে হজে যাওয়ার জন্য জমাকৃত অর্থ দান করে জনৈক ব্যক্তি হজে না গিয়েও আল্লাহ্র দরবারে হজ কবুল হয়েছে- এমন একটি ঘটনা মুসলমানের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
প্রখ্যাত সুফি সাধক সুলতানিয়া-মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ইমাম সৈয়দ আবুল ফজল সুলতান আহমদ (রহ.) ফরমান- ‘‘আলী ইবনে মোয়াফেক নামে দামেস্কের অধিবাসী এক দরিদ্র মুচি দীর্ঘ ৩০ বছর তার কষ্টার্জিত অর্থ থেকে সঞ্চয় করেছিলেন হজ করার জন্য। তিনি যখন হজে যাবেন, তার আগের দিন তার স্ত্রী বলল, আমি মাংস খাবো। তিনি বললেন, আমার কাছে বাড়তি টাকা নেই মাংস কেনার মতো। হজের টাকা থেকে যদি মাংস কিনি, তবে আমার হজে যাওয়া হবে না। তখন তিনি স্ত্রীর আবদার রাখতে গিয়ে পাশের বাড়িতে গেলেন একটু মাংস আনার জন্য। তিনি তার প্রতিবেশীকে বললেন, আপনার বাড়ি থেকে মাংস রান্নার ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের একটু মাংস দিন। আমার স্ত্রী মাংস খেতে চাচ্ছে; বাজার থেকে যদি মাংস কিনে আনি তবে আমার হজে যাওয়ার টাকা কম হয়ে যাবে। তখন ঐ বাড়িওয়ালা বলল, ভাই! এ মাংস আমাদের জন্য হালাল কিন্তু আপনাদের জন্য হারাম। কারণ সাত দিন যাবৎ আমরা অনাহারে আছি। অবশেষে অনাহারক্লিষ্ট ছেলে-মেয়েদের কান্নাকাটি সহ্য করতে না পেরে নদীর পানিতে ভেসে যাওয়া একটা মরা গাধা তুলে এনে মাংস রান্না করে খাচ্ছি। কাজেই এটা আমাদের মতো অনন্যোপায় ব্যক্তিদের জন্য হালাল, কিন্তু আপনাদের জন্য হালাল নয়। এ কথা শুনে হজে যেতে প্রস্তুত ব্যক্তি (মুচি) স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ভাবলেন, হায়রে! আমি কেমন মুসলমান! আল্লাহ্র বান্দাদের এমনিভাবে অভুক্ত রেখে হজে গিয়ে আমার কী লাভ হবে? অতঃপর আলী ইবনে মোয়াফেক হজে না গিয়ে তার সঞ্চিত সমস্ত টাকা ঐ পরিবারের লোকদের দিয়ে দিলেন। ফলে আলী ইবনে মোয়াফেকের হজে যাওয়া হলো না। সেই বছর হজ সম্পন্ন হওয়ার পর আরবের বিখ্যাত বুজুর্গ, আল্লাহ্র অলী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) খানায়ে কাবায় ঘুমিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি স্বপ্নে দেখেন- উর্ধ্বলোক থেকে দুজন ফেরেশতা অবতরণ করে তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে একজন অন্যজনকে জিজ্ঞেস করল, এবার কত লোক হজ করতে এসেছে? অপর ফেরেশতা বলল-‘ছয় লক্ষ’। প্রশ্নকারী ফেরেশতা আবার জিজ্ঞেস করল- এরমধ্যে কত জনের হজ কবুল হয়েছে? অপর ফেরেশতা বলল- ‘এবার কারো হজ কবুল হয়নি। তবে একজন মাত্র ব্যক্তির হজ কবুল হয়েছে। দামেস্ক শহরের আলী ইবনে মোয়াফেক, যদিও সে হজ করতে আসেনি। আর আলী ইবনে মোয়াফেকের উসিলায় মহান আল্লাহ্ সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের হজের সওয়াব দিয়েছেন, যারা হালাল অর্থ দিয়ে নেক নিয়তে হজ করেছে।’
এই স্বপ্ন দেখে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.)-এর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি আলী ইবনে মোয়াফেকের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তিনি দামেস্কের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি আলী মুচির দ্বারস্থ হলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন- আলী! আপনি এমন কি কর্ম করেছেন, যে কর্মে খুশি হয়ে হজে না যাওয়া সত্তে¡ও মহান রাব্বুল আলামিন আপনার হজ কবুল করেছেন? এ মহা আনন্দের সংবাদ শুনে আলী ইবনে মোয়াফেকের জজবা হয়ে যায়। তিনি আল্লাহ্র এশকে বেহুঁশ হয়ে গড়াগড়ি খেতে থাকেন। হুঁশ ফিরে আসলে আলী ইবনে মোয়াফেক আল্লাহ্র বন্ধু হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.)-কে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। অতঃপর আল্লাহ্র অলী আবদুল্লাহ্ ইবনে মুবারক (রহ.) আলীকে আরো জানান যে, হে আলী! হজের জন্য ত্রিশ বছরে জমানো টাকা সাত দিনের অনাহারীকে দান করায় মহান আল্লাহ আপনার হজ এমনভাবে কবুল করেছেন যে, তিনি আপনার পক্ষে হজ করার জন্য একজন ফেরেশতাকে নিয়োগ করেছিলেন, যে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি মোতাবেক হজ সুসম্পন্ন করেছে। (তথ্য সূত্র: তাফসীরে সূফী সম্রাট দেওয়ানবাগী ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৭৩; সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩ এবং তাযকেরাতুল আওলিয়া ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৮)
এ ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রতিবেশীর প্রতি উত্তম ব্যবহার করলে এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে তাদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ালে আল্লাহ্ অত্যন্ত খুশি হয়ে থাকেন। আর এর প্রতিদানস্বরূপ দানকারী বান্দাকে অপরিসীম দয়া ও রহমত প্রদান করে থাকেন। সুতরাং আমরা যেন কখনো প্রতিবেশীদের সাথে সামান্যতম শত্রæতাও না রাখি। বরং প্রতিবেশীর প্রতি যেন সুসম্পর্ক রেখে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করি। আল্লাহ্ আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।