পৃথিবী বদলে দেওয়া আবিষ্কার

পৃথিবী বদলে দেওয়া আবিষ্কার

তানভীর আহমেদ
মানব সভ্যতার বিকাশে যুগে যুগে মানুষ করেছে বিস্ময়কর সব আবিষ্কার। এসব আবিষ্কার বদলে দিয়েছে আমাদের চিরচেনা দুনিয়াটাকেই। শুধু জীবনযাত্রা সহজ করতেই নয়, কিছু কিছু আবিষ্কার সম্ভাবনার অপার দ্বার খুলে দিয়েছে ভবিষ্যতের জন্য। বিভিন্ন আঙ্গিকে আবিষ্কারগুলো ছিল অনন্য। তেমনি কিছু আবিষ্কারের গল্প নিজে উল্লেখ করা হলো-
মানব সভ্যতার বিকাশে সেরা আবিষ্কার বিদ্যুৎ
আধুনিক সভ্যতা বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনা করা যায় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে সহজ হয়েছে মানুষের জীবনযাপন। আর এর অধিকাংশই নির্ভরশীল বিদ্যুতের ওপর। তাই শুধু শত সহস্র বছরেরই নয়, বিদ্যুৎ নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সর্বকালের সেরা আবিষ্কার। বিদ্যুতের মাধ্যমে পরবর্তীতে যেসব যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়, তার সব কটিই ইতিহাস সেরা আবিষ্কার। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ইতিহাস পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্টকে বলা হয় বিদ্যুতের আবিষ্কারক। তিনি ১৫৭০ সালে প্রথম বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেন। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও বেশ কিছু বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম- আলেসান্দ্রো ভোল্টা, লইগি গ্যালভানি, মাইকেল ফ্যারাডে ও থমাস আলভা এডিসন। তারা প্রত্যেকেই বিদ্যুতের বিভিন্ন দিক উদ্ভাবন করেছেন। তবে বিদ্যুৎ আবিষ্কারে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন থমাস আলভা এডিসন। তার বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় বিদ্যুতের আবিষ্কার। ১৮৮২ সালে এডিসনই প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্টেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বিদ্যুতের ওপর গবেষণা শুরু হয় ১৬ শতকের দিকে। ১৮ শতকের মাঝামাঝি আমেরিকান বিজ্ঞানী বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রথম বিদ্যুতের ওপর ব্যবহারিক গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু এ সময় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যেত না। শুধু সাময়িক সময়ের জন্যই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যেত। ১৮৪০ সালে আবিষ্কৃত টেলিগ্রাফও ব্যাটারির মাধ্যমে চালানো হতো। এরই মাঝে ফ্যারাডের একটি আবিষ্কারের সূত্র ধরেই ১৮৩১ সালে ডায়নামো আবিষ্কার করা হয়। তবে এই যাত্রার শেষ হয় জোসেফ সোয়ান ও থমাস আলভা এডিসনের হাত ধরে। জোসেফ সোয়ান ১৮৫০ সালের দিকে ভ্যাকুয়াম টিউবের ভেতর ফিলামেন্ট রেখে বাতি জ্বালানোর কৌশল দেখান। ফিলামেন্ট হিসেবে তিনি ব্যবহার করেন কার্বনযুক্ত কাগজ। তবে সে সময়ে এই ভ্যাকুয়াম টিউবের পদ্ধতি ছিল বেশ ব্যয়বহুল। ফলে তার এ পদ্ধতি শুধু আবিষ্কার হিসেবেই অসাধারণ ছিল; দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য নয়। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার সব সরঞ্জাম হাতের নাগালে পায়। পৃথিবীর সব প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পেছনেই এক নম্বর অবস্থানে আছে বিদ্যুৎ। তাই এই বিদ্যুৎকে বলা হয় আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম সেরা আবিষ্কার।

হিসাব-নিকাশের অবাক যন্ত্র
এক সময় মানুষ হাতের আঙুল গুণে হিসাবের কাজ চালাত। বণিকরা ছোট পাথরের টুকরো বা ফলের বীজ দিয়ে চালাত তাদের গণনার কাজ এবং হিসাব-নিকাশ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ব্যাবিলনীয় বণিকগণ ক্লে ট্যাবলেটে তাদের উপাত্ত সংরক্ষণ করতেন। প্রাচীন চীনের অধিবাসীরা রড নিউমেরালস (জড়ফ ঘঁসবৎধষং) নামক পদ্ধতি ব্যবহার করত গণনার জন্য। সময় তখন খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দ। চীনাদের অ্যাবাকাস ছিল একটি হস্তচালিত আদি গণনাকারী যন্ত্র। আবিষ্কারের পর থেকে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের ধারাবাহিকতায় নিরীক্ষা (গ্রিকরা) এবং বাজেট (রোমানরা) সংরক্ষণের নবধারা হিসেবে রেকর্ড-কিপিং কৌশলের উন্নয়ন অব্যাহত থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। ইতিহাস থেকে যা জানা গেছে তা হলো- প্রায় ৪ হাজার বছর আগে চীনারা গণনা করার জন্য একটি যন্ত্র তৈরি করে। যার নাম ছিল অ্যাবাকাস। এটিই হলো পৃথিবীর প্রথম গণনাকারী যন্ত্র। আর এটিই হলো বর্তমান কম্পিউটারের পূর্বপূরুষ। প্রাচীন জাপান, ভারত, চীন এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। ১৬৪২ সালে বে¬ইজ প্যাসকেল নামে একজন ফরাসি যুবক প্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর যন্ত্রের উন্নয়ন করেছিলেন। এর ৩০ বছর পর ভিলহেলম লিবনিজ নামের এক জার্মান গণিতবিদ প্যাসকেলের উদ্ভাবিত যন্ত্রের উন্নয়ন করে একটি যন্ত্র উপস্থাপন করেন যার মাধ্যমে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং সংখ্যামূল বের করা যেত।
সভ্যতার গতি বাড়িয়েছে চাকা
চাকাকে বলা হয় সভ্যতার গতি। চাকা আবিষ্কার হওয়ার আগে মানুষ নিজেই বহন করত তার যাবতীয় ভারের বোঝা। এক সময় বনের পশুকে পোষ মানাতে শেখে আদিম মানুষ। এসব প্রাণীর পিঠে বোঝা চাপিয়ে শুরু হয় পণ্য বহন। সভ্যতার ক্রমবিকাশ হতে থাকে এভাবে। মানুষ যে আদিকাল থেকে গতি পছন্দ করত, তা প্রকাশ পেতে থাকে ধীরে ধীরে। একপর্যায়ে গাছের গুঁড়ির চাকতি কেটে তার মাঝ বরাবর ছিদ্র করা হয়। এটাই সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম চাকা। এটি এতটাই পুরনো এক আবিষ্কার যে, ঠিক কবে এই চাকার আবিষ্কার হয়েছিল তা কেউ জানে না। তবে সবচেয়ে পুরনো চাকাটি পাওয়া গিয়েছিল স্লোভেনিয়াতে খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দে। ধারণা করা হয়, চাকার আবিষ্কার হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ বছর আগে। আবার ইতিহাস বলে ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় চাকা আবিষ্কার হয়। ককেশাসের উত্তরে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে, যাতে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছে। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন। চাকা ব্যবহার করে জলচক্র পানি তোলার এবং পানি থেকে শক্তি আহরণের, গিয়ার চাকা, চরকা ইত্যাদি তৈরি করা হয়। সাম্প্রতিককালের প্রপেলার, জেট ইঞ্জিন এবং টারবাইনের সবই চাকার পরিবর্তিত রূপ।
বীজগণিত ও মানুষের চোখ
বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে গণিতের ভিতের ওপর। আর গণিত দাঁড়িয়ে আছে বীজগণিতের ওপর। ‘আলজেবরা’ গাণিতিক হিসাব পদ্ধতিকে সহজ করে দিয়েছে। তাই আজ এই শাস্ত্রটির ব্যবহার ও শিক্ষা সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। পৃথিবীর প্রথম বীজগণিত নিয়ে প্রথম গ্রন্থটি রচনা করেছেন পার্সিয়ান বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজম। সপ্তম শতকে তিনি রচনা করেন দ্বিতীয় গ্রন্থ’ ‘আল-জাবর ওয়াল মুকাবলা’। তার রচিত বইটিই মূলত আলজেবরা। মুসলিম এই গণিতবিদ রচিত বীজগণিতের ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক গণিতের যাত্রা ও পথচলা শুরু হয়। এদিকে তৎকালীন আরব বিশ্ব শুধু গণিতেই রৈূপ্লবিক পরিবর্তন আনেনি, বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমানভাবে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। তারা বিবর্ধক কাচ বা চশমার ক্ষেত্রেও বৈপ্ল¬বিক পরিবর্তন আনেন। বসরা নগরীর বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আলহাজেন সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন চোখের গঠন প্রণালি এবং চোখ কীভাবে কাজ করে। তিনিই প্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রমাণ করেন, চোখের দৃষ্টি রশ্মির সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অনুভূতি নেই। এছাড়া তিনিই প্রথম চশমার ধারণা দিয়ে বলেন, বাঁকানো কাচের পৃষ্ঠতল চোখের দৃষ্টি সহায়ক হিসেবে বিবর্ধনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *