মাহমুদ আহমদ: বিশ্বমানবতা আজ মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন। সর্বত্র ন্যায়বিচারের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অশান্ত বিশ্বকে শান্তিময় করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নিরঙ্কুশ ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ইসলাম অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে যারা ইমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সাক্ষ্যদাতা হিসাবে দৃঢ়ভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকারী হও, এমনকি সেই সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে গেলেও। যার সম্পর্কে সাক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে সে ধনী হোক বা গরিব হোক আল্লাহই উভয়ের সর্বোত্তম অভিভাবক। অতএব, তোমরা যাতে ন্যায়বিচার করতে সক্ষম হও সেজন্য তোমরা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।
আর তোমরা যদি প্যাঁচানো কথা বলো অথবা সত্যকে এড়িয়ে যাও, তবে মনে রেখ তোমরা যা করেি সে বিষয়ে নিশ্চয় আল্লাহ পুরোপুরি অবগত আছেন। (সূরা নিসা ৪: আয়াত ১৩৫) অপর এক স্থানে বলা হয়েছে, ‘হে যারা ইমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায়ের পক্ষে সাক্ষী হিসাবে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হও। আর কোনো জাতির শত্রুতা যেন কখনোই তোমাদের অবিচার করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা সদা ন্যায়বিচার কর। এ কাজটি তাকওয়ার সবচেয়ে কাছে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। তোমরা যা কিছু কর নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে পুরোপুরি অবগত আছেন’ (সূরা মায়েদা, আয়াত : ৮)।
ইসলামের শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো সমাজ ও দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এটি এমন এক অনিন্দ সুন্দর শিক্ষা যে, প্রত্যেক ন্যায়পরায়ণ অমুসলিমও এ শিক্ষা শুনে প্রশংসা না করে পারে না। কিন্তু তারা প্রশ্ন করে, এ শিক্ষার ওপর মুসলমানদের আমল কোথায়? পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই মানবতার নবি ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক মহানবি (সা.)-এর আগমন।
তিনি নিজ আমল দ্বারা সর্বত্র ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমও হয়েছিলেন। যেভাবে কুরআনে বলা হয়েছে ‘বলো, আমার প্রভু আমাকে ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সূরা আরাফ ৭: আয়াত ২৯) অপর এক স্থানে বলা হয়েছে ‘তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি।’ (সূরা আশ শুরা ৪২: আয়াত ১৫)
আল্লাহ তায়ালার অনুপম শিক্ষা এবং ইসলামের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বহিঃপ্রকাশ তখনই সম্ভব হবে যখন প্রত্যেক মুসলমান আল্লাহ পাকের প্রতিটি আদেশের ওপর আমল করবে। ন্যায়বিচারের আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজেদের ঘর, সমাজ, আপন-পর, এমনকি শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার সঙ্গে ন্যায়সুলভ ব্যবহারের মাধ্যমেই একটি সুন্দর সমাজ ও দেশ প্রতিষ্ঠা পায়।
ন্যায়বিচারের উচ্চ মানদণ্ড সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাড়া সম্ভব নয়। মহানবি (সা.)-এর নির্দেশ হলো ‘তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ করো তা অন্যদের জন্যও পছন্দ করো।’ আমরা যদি এ হাদিসের ওপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হই তাহলেই কেবল ন্যায়বিচার সম্ভব। সাধারণত আমরা কি দেখি, নিজের অধিকার পুরো আদায়ের ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর অথচ অন্যের অধিকারের প্রতি সামান্যতম চিন্তা করি না। সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য আমাদের যদি নিজ আত্মীয়স্বজন ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অসন্তুষ্টিরও সম্মুখীন হতে হয় তারপরও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না।
ইসলামের শিক্ষা কতই না চমৎকার, বলা হয়েছে শত্রুরাও যদি তোমাদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষী হয় তারাও যেন তা পায়। কারও বিরোধিতা আমাদের যেন ন্যায়বিচার বা সত্যতা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। আমাদের হৃদয় যেন সব ধরনের শত্রুতা থেকে মুক্ত থাকে। আমরা যেন আল্লাহ পাকের কাছে এ ঘোষণা করতে পারি, হে আল্লাহ! কারও সঙ্গে আমাদের কোনো বিদ্বেষ ও শত্রুতা নেই।
আজ পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, সত্যের বিস্তার করার জন্য, শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের ওপর অনেক বড় দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে অথচ যারা ন্যায়বিচারের জন্য আদিষ্ট হোন তারা সবাই আল্লাহ পাকের আদেশকে ভুলে বসেন।
আমরা যারা নিজেকে মুসলমান হিসাবে দাবি করি, আমাদের প্রত্যেককে এ অঙ্গীকার করা উচিত, আমরা নিজেদের ঘর এবং সমাজের মাঝে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করে সমাজ ও দেশকে জান্নাত সদৃশ্য বানাব। পৃথিবীতে প্রকৃত ন্যায়ের শিক্ষা সুস্পষ্ট করে পৃথিবীকে ধ্বংসের গহ্বরে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষাকারী হব। সমগ্র বিশ্ব অত্যন্ত বিপদসংকুল ধ্বংসের দিকে অতিদ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। মুসলমান, অমুসলিম কারও মাঝে আজ ইনসাফ অবশিষ্ট নেই আর কেবল যে ইনসাফই অবশিষ্ট নেই তা নয় বরং জুলুমের সব সীমাগুলোকেও ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে পৃথিবীর চোখ উন্মোচন আর জুলুম থেকে বিরত রাখার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ধ্বংসের গহ্বরে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষার দায়িত্ব কেবল মুসলমানরাই পালন করতে পারে। কারণ মুসলমানদের আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের মতো এমন এক অস্ত্র দান করেছেন যার ছায়াতলে আশ্রয় নিলে সবাই মুক্তি পেতে পারে। যাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা বিচারকার্য পরিচালনার ভার ন্যস্ত করেছেন তাদের বলা হয়েছে, তারা যেন ন্যায়বিচারের পরিপূর্ণ হক আদায় করেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে।’ (সূরা নিসা ৪: আয়াত ৫৮) আরেক স্থানে বলা হয়েছে ‘তুমি তাদের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করলে সুবিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা মায়েদা ৫: আয়াত ৪২)।
আজকে ন্যায়বিচারের বড়ই অভাব আর এ কারণেই ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না। মানবতার এই ক্রান্তিলগ্নে মানবতাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য নিরঙ্কুশ ন্যায়বিচারের বিকল্প নেই। আল্লাহতায়ালা নীতিনির্ধারকদের ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
