মাসুদ মিলাদ: সকালবেলায় চায়ের কাপে চুমুক না দিলে আজকাল অনেকের যেন দিনই শুরু হয় না। তবে চায়ের পাশাপাশি এখন একটু একটু করে কফির কাপেও জোরেশোরে ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে। অর্থাৎ কফি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বদৌলতে এটির বাজার বাড়ছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের এই সুযোগ কাজে লাগাতে মাঠে নেমেছে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। বিদেশ থেকে আমদানির পাশাপাশি তাদের কেউ কেউ দেশে কফি চাষে যুক্ত হচ্ছে।
চা-কফি উৎপাদন ও আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে এক দশক ধরে চায়ের চাহিদা বছরে ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর কফির বাজার বাড়ছে ৫৬ শতাংশ হারে। অর্থাৎ চায়ের তুলনায় কফির চাহিদা ১১ গুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে কফির তুলনায় চায়ের বাজার এখনো ৫৩ গুণ বড়।
বাংলাদেশে কফির নিয়মিত বাজারের শুরুটা হয়েছিল সুইজারল্যান্ডের বহুজাতিক খাদ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নেসলের হাত ধরে। ১৯৯৮ সালে নেসলে প্রথম এ দেশে কফি বাজারজাত করে। এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে কফি আমদানি হতো। কফি বাজারজাতকরণের শুরুর দিকে চাহিদা ছিল কম। যেমন ২০০৩ সালে কফি আমদানি হয় ১৩৯ টন। সে সময় বাজারের ৬৭ শতাংশই ছিল নেসলের দখলে, আর কফি বলতে ছিল ইনস্ট্যান্ট কফি।
ঐতিহাসিকভাবে চা পানে অভ্যন্ত এ দেশের মানুষ এখন কফিতে ঝুঁকছেন। মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে খাদ্যাভ্যাসে এই পরিবর্তন আসছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে কফি পান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এই শতকের প্রথম দশকেও কফির বাজার খুব একটা বড় হয়নি। বছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশের মতো। মূলত দ্বিতীয় দশক থেকেই কফির চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ইনস্ট্যান্ট কফির পাশাপাশি নানা বৈচিত্র্যের কফি বাজারে নতুন মাত্রা যোগ করে। বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন আউটলেট স্থাপনে বিনিয়োগ করেন শিল্প উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে নর্থ এন্ড, গ্লোরিয়া জিনস, ক্রিমসন কাপ, বারিস্তা, বাত্বীল ও সেগাফ্রেডো উল্লেখযোগ্য। পাড়ামহল্লায়ও কফি শপ গড়ে তোলেন ছোট ছোট উদ্যোক্তারা। সর্বত্রই কফি শপগুলোয় ভোক্তাদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
এদিকে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি অনেক সাধারণ উদ্যোক্তাও সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে কফি চাষে এগিয়ে আসছেন। আমদানি, চাষাবাদ ও বিক্রির আউটলেট স্থাপন সব ক্ষেত্রেই একসঙ্গে গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় কফির বাজারে এখন যেন জোয়ার চলছে।
আমদানির তথ্যে দেখা যায়, ২০১২ সালে দেশে কফি আমদানি হয়েছিল ২৬৪ টন। এক দশকের ব্যবধানে গত বছর আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৪৫ টন। সেই হিসাবে দেশে কফির বাজার বছরে গড়ে ৫৬ শতাংশ হারে বাড়ছে বলা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৪০টির মতো দেশ থেকে কফি আমদানি হয়। এর মধ্যে কফি উৎপাদনে শীর্ষ ১০ দেশের ৮টি থেকেই কফি আমদানি হচ্ছে। তবে ৮৮ শতাংশ কফিই আসছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল ও ভিয়েতনাম-এই পাঁচ দেশ থেকে।
‘আমদানিকারকেরাই দেশে উৎপাদিত কফি সংগ্রহ করতে চাইছেন। বাজার ভালো থাকায় কৃষকেরাও এটি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে প্রতিবছর চাষের আওতা যেমন বাড়ছে, তেমনি কফি চাষকারী কৃষকের সংখ্যাও বাড়ছে।’
নেসলের পর বাজারে বড় তিন শিল্পগোষ্ঠী
নেসলের পর তিনটি বড় শিল্পগোষ্ঠীসহ আড়াই শতাধিক প্রতিষ্ঠান এখন কফি আমদানি ও বাজারজাত করছে। বড় তিন গ্রুপ হলো প্রাণ আরএফএল, আবুল খায়ের ও বেক্সিমকো। এর মধ্যে প্রাণ আরএফএল গ্রুপ এই ব্যবসায়ে আসে ২০১৩ সালে। তবে তারা বড় আকারে কফি আমদানি ও বাজারজাত শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। গত বছর দেশে মোট কফি বিপণনের ৬ শতাংশ করছে তারা।
জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএফ গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ঐতিহাসিকভাবে চা পানে অভ্যন্ত এ দেশের মানুষ এখন কফিতে ঝুঁকছেন। মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে খাদ্যাভ্যাসে এই পরিবর্তন আসছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে কফি পান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কফির বাজার দ্রুত বড় হওয়ায় প্রাণ গ্রুপ নানা বৈচিত্র্যের কফি বাজারজাতকরণের পরিকল্পনা করছে।
আবুল খায়ের গ্রুপ আমা ব্র্যান্ডের ইনস্ট্যান্ট কফি বাজারজাত করছে। তিন বছর আগে গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের কনজ্যুমার প্রোডাক্টস কফি বাজারজাত শুরু করে। গত বছর কফি আমদানিতে গ্রুপটি ছিল সপ্তম অবস্থানে। অবশ্য এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে গ্রুপটি দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে।
কফির বাজারে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। গ্রুপটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফুডস ‘বাত্বীল’ নামক ব্র্যান্ডের কফি বাজারজাত করছে। রাজধানীতে বাত্বীলের আউটলেটে বিক্রি হচ্ছে এই কফি।
এ ছাড়া এসএমবি ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড সাপ্লাই বাজারজাত করছে ম্যাককফি। কফিকো ও টোরা বিকা ব্র্যান্ডের কফি বাজারজাত করছে ওমেগা ডিস্ট্রিবিউশন।
নেসলে বাংলাদেশ ইনস্ট্যান্ট কফি এনে দেশে প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেটজাত করার মাধ্যমে মূল্য সংযোজন করছে। এ জন্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানা করেছে নেসলে।
কফি চাষে দিনবদলের হাওয়া
এক দশক আগে পার্বত্য এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে সীমিত আকারে কফি চাষ শুরু হয়। কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের সাত জেলায় দুই হাজার কৃষক কফি চাষে যুক্ত রয়েছেন। ফলন বেশি হওয়ায় এখন উঁচু এলাকায় অ্যারাবিকা ও রোবাস্টা জাতের কফির চাষও শুরু হয়েছে দেশে।
কফিসহ কাজুবাদাম চাষ বাড়াতে সরকার ২০২১ সালে ২১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রাসারন’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে কৃষকদের মধ্যে বিনা মূল্যে চারা বিতরণসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ বছর সাত লাখ কফিগাছের চারা বিতরণ করা হবে। চারা লাগানোর তিন বছর পর কফির ফলন আসে।
কৃষি সম্প্রাসারন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আবুল খায়ের গ্রুপ পার্বত্য এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কফি চাষ করছে। নর্থ এন্ড কোম্পানিও এক দশক ধরে পার্বত্য এলাকায় কফি চাষে কৃষকদের সহযোগিতা করছে। নিজেদের আউটলেটে পার্বত্য এলাকার কফি ব্র্যান্ডিং করছে তারা। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপাদিত কফি বাজারজাত শুরু করেছে নর্থ এন্ড। ‘হিল ট্র্যাক্ট বেন্ড’ নামে প্যাকেটজাত করে তারা কফি বাজারজাত করছে।
জানতে চাইলে ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রাসারন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানিকারকেরাই দেশে উৎপাদিত কফি সংগ্রহ করতে চাইছেন। বাজার ভালো থাকায় কৃষকেরাও এটি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে প্রতিবছর চাষের আওতা যেমন বাড়ছে, তেমনি কফি চাষকারী কৃষকের সংখ্যাও বাড়ছে।’
তিন পার্বত্য জেলার পাশাপাশি টাঙ্গাইল, রংপুর, নীলফামারী জেলাসহ দেশের নানা এলাকায় এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কফি চাষ হচ্ছে। এমনই একজন কফিচাষি রংপুরের মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, কফি চাষে খরচ কম, লাভ বেশি। তবে ফলন তোলার পর প্রক্রিয়াজাতকরণের যে কয়েকটি ধাপ রয়েছে, তা উন্নত করতে হবে। তাঁর বাগান থেকে চারা নিয়ে ৬২টি বাগান তৈরি হয়েছে বলেও জানান তিনি।
স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা দাবি
বর্তমানে রোস্টেড (ভাজা) ও নন রোস্টেড কফি আমদানিতে শুল্কহার আড়াই কেজি পর্যন্ত প্যাকেটে ৮৯ শতাংশ এবং বাল্ক বা খোলা আকারে আমদানিতে প্রায় ৫৯ শতাংশ। তবে ইনস্ট্যান্ট কফির ক্ষেত্রে প্যাকেটজাত ও বাল্ক আকারে আমদানিতে শুল্কহার ৮৯ শতাংশ। এ কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান কফি প্রক্রিয়াকরণের কারখানা করেছে, তারা সুবিধা পাচ্ছে না। তাই সরাসরি খুচরা প্যাকেটের পরিবর্তে যারা দেশে প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেটজাত করার মাধ্যমে মূল্য সংযোজন করছে, তাদের সুবিধা দেওয়া হলে নতুন নতুন বিনিয়োগ আসবে বলে জানান উদ্যোক্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক ও কোম্পানি সচিব দেবব্রত রায় চৌধুরী বলেন, নেসলে বাংলাদেশ ইনস্ট্যান্ট কফি এনে দেশে প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেটজাত করার মাধ্যমে মূল্য সংযোজন করছে। এ জন্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানা করেছে নেসলে।
কিন্তু সরাসরি খুচরা বিক্রির জন্য প্যাকেটজাত আকারে আমদানি ও বাল্ক আকারে আমদানিতে একই শুল্কহার রয়েছে। এ কারণে নেসলের মতো যাদের প্রক্রিয়াকরণ কারখানা রয়েছে, তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য ইনস্ট্যান্ট কফি আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক অব্যাহতি দিলে এই খাতে নতুন বিনিয়োগ আসবে।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও সম্ভব
ইতিহাস বলছে, নবম শতকে ইথিওপিয়ায় প্রথম কফির উৎপত্তি হয়েছিল। পরবর্তীকালে ইথিওপিয়া থেকে বিভিন্ন আরব দেশে কফি যায়। এরপর ধীরে ধীরে তা ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ শুরু হয় কফি আবিষ্কারের শত শত বছর পরে, তা-ও এ শতকে।
কৃষি সপ্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সপ্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, দেশে গত কয়েক বছরে কফি চাষে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে এসেছেন। এটি অব্যাহত থাকলে ১০ বছর পরে আর কফি আমদানি করতে হবে না। দেশে উৎপাদিত কফি দিয়ে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করাও সম্ভব হবে।