দেওয়ানবাগ ডেস্ক: দেশে বয়সভিত্তিক জনসংখ্যায় কমে আসছে কন্যাশিশু। পাঁচ বছর আগেও কন্যাশিশুর হার ছিল প্রায় ৩১ শতাংশ। সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে তা ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে চার বছরের ব্যবধানে কন্যাশিশু কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১ শতাংশ হারে কমছে কন্যাশিশু।
দেশের এই পরিস্থিতির মধ্যে আজ ৩০ সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। এবারের কন্যাশিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সময়ের অঙ্গীকার, কন্যাশিশুর অধিকার’।
প্রতিবছর মেয়ে শিশুর জন্মহার কমার পেছনে গর্ভপাত, আঞ্চলিক প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক অবিচার ও কুসংস্কার, দারিদ্র্য ও সার্বিক প্রজননকে দায়ী করেছেন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা। মেয়ে শিশু জন্ম নিলে এখনো মন খারাপ করে পরিবার। শহর বা গ্রামে—সবখানে এ প্রবণতা কমবেশি দেখা যায়। শিক্ষার অভাব, সচেতনতা, কুসংস্কার, পরিবারের বোঝা হিসেবে গণ্য করা এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সার্বিক প্রজনন কমে আসা, গর্ভপাত, বাড়িতে সন্তান প্রসব করা—এ কারণগুলো মুখ্য। এর বাইরে মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে মন খারাপ হয়ে যাওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বেশির ভাগ মানুষ। অনেকে ভাবেন, মেয়েকে লালন-পালন করে তো পরের ঘরেই দিতে হবে। বিয়েশাদিতে খয়খরচা আছে। অনেক সময় ঠেকায় পড়ে যৌতুকের দায়ও সামলাতে হয়। সব মিলিয়ে কন্যাশিশুর প্রতি একটা বিরূপ ধারণা জন্মে। বিশেষ করে গ্রামীণ অনগ্রসর সমাজে ছেলের চেয়ে মেয়ের গুরুত্ব অনেক কম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস)-২০২০-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবছরই মেয়ে শিশুর জন্মহার কমতে শুরু করেছে। ২০১৬ সালে মোট নারী জনসংখ্যায় কন্যাশিশু ছিল ৩০.৭ শতাংশ, ২০১৭ সালে তা কমে হয় ২৯.২ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ২৮.৪ শতাংশ, ২০১৯ সালে ২৮.৩ শতাংশ ও ২০২০ সালে তা আরো কমে ২৮.২ শতাংশে নেমে আসে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে বছরে ১২ লাখ গর্ভপাত হয়। এর মধ্যে ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত ছয় লাখ। অনিচ্ছাকৃত বা অকাল গর্ভপাত ছয় লাখ। প্রতি চারজন গর্ভবতীর মধ্যে তিনজন অপরিকল্পিত গর্ভধারণ করেন; অর্থাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ।
অবস্ট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, চরম বাস্তবতায় দেখা যায়, গর্ভপাত না করলে মেয়ের ওপর অত্যাচার করা হয়। যখনই স্বামী বা তার পরিবার জানতে পারে কাঙ্ক্ষিত জেন্ডার নয়, তখন মায়ের ওপর অত্যাচার নেমে আসে। মানসিক উত্পীড়ন করা হয়। সামাজিক সম্মান থেকে শুরু করে সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন এটির সঙ্গেই সম্পৃক্ত। ছেলে, নাকি মেয়ে শিশু—এটা বলার অনুমতি সরকার থেকে নেই। এর পরও বেসরকারিভাবেও মা-বাবারা জানার চেষ্টা করেন। অনেকে বাড়িতে অদক্ষভাবে সেপটিক অ্যাবরশন (গর্ভপাত) করান।
ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, জন্মের পর থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত নবজাতকের মৃত্যুহার এখন ৩০ শতাংশ। জন্ম নেওয়া প্রতি হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে ২৮ থেকে ৩০ জন মারা যায়। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি কমিয়ে ১২ জনে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ঘরে সন্তান প্রসব করায় শিশু মৃত্যুহার বেশি হয়।
এ বিষয়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা (চরাঞ্চল, নদীভাঙনপ্রবণ) সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলা সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
সিরাজগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. রামপদ রায় বলেন, চর এলাকা হওয়ায় আঞ্চলিক কুসংস্কার এখানে বদ্ধমূল। এ জন্য হাসপাতালে এসে ডেলিভারি না করিয়ে ঘরেই ডেলিভারি করানো হয়। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির হার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ মাত্র।
তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারেই দেখেছি, প্রথম সন্তান মেয়ে হয়েছে, দ্বিতীয় সন্তান আবার মেয়ে হলে মন খারাপ করেন। ছেলে সন্তান হতে হবে-এমন ধারণা থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেননি মা-বাবারা। ’
গাইবান্ধা সিভিল সার্জন ডা. আ ক ম আকতারুজ্জামান বলেন, দুর্গম এলাকাগুলোতে সচেতনতা পৌঁছে দেওয়া কষ্টসাধ্য। গাইবান্ধায়ও প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি ৫০ শতাংশের অনেক কম। হাসপাতালে কেউ আসতেই চায় না।
কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুরুল মোর্শেদ বলেন, চর এলাকাগুলোতে হাসপাতালে ডেলিভারি করার প্রবণতা কম ছিল। এখন ধীরে ধীরে মানুষ হাসপাতালমুখী হচ্ছে। এখানে প্রায় ৫৫ শতাংশ ডেলিভারি হাসপাতালে হয়।