দায়িত্ব বদল হচ্ছে পরিবারের

দায়িত্ব বদল হচ্ছে পরিবারের

রাবেয়া বেবী: মো. হাবীব উল্লাহ ও রেহানা বেগমের একমাত্র ছেলে থাকেন আমেরিকায়। ছয় বছর ধরে প্রতি শনি ও রবিবার মা-বাবা ও ছেলের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও কলে কথা হয়। ছেলে প্রকৌশলী আর বউ মা চিকিৎসক। তাদের সঙ্গে এক পরিবারে একদমই থাকা হয়নি হাবীব উল্লাহ ও রেহানা বেগমের। বাবা হাবীব উল্লাহ জানান, ‘আমার দুই মেয়ে ঢাকায় আছে, বড় মেয়ে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমাদের পাশাপাশি বাড়ি। তারা আপদবিপদে পাশে থাকে। অন্যদিকে ছেলের বউ প্রতি সপ্তাহে কথা বলে, মাসে দুই বার বেতন পেয়ে দুই বারই টাকা পাঠায়। কোরবানি ঈদ, জাকাত, ফেতরার টাকাও চলে আসে সময়মতো। মা-বাবা দিবসের উপহারও পাই অনলাইনের মাধ্যমে।’ আর মা জানান, ‘প্রতি সপ্তাহেই কথা বলি, তারপরও ফোন করলে কান্নায় গলা ধরে আসে, কথা বলতে পারি না।’ শুধু মো. হাবীব উল্লাহ ও রেহানা বেগমের পরিবার নয়, আজ বিশ্বময় পরিবারের বিস্তৃতি লাভ করার দায়িত্বগুলোর হাত বদল হচ্ছে। বাবা-মায়ের পাশে থাকছে মেয়েরা, বিদেশে অবস্থানরত সন্তান উপহার পাঠাচ্ছেন অনলাইনের মাধ্যমে।
বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী। নিউক্লিয়ার পরিবার হওয়ায় সারা দিন সন্তান পালনের দায়িত্ব নিচ্ছে ডে কেয়ার। ইতিবাচকই হোক আর নেতিবাচকই, অনেক সময় ওল্ডহোম বা প্রবীণ নিবাসের চাহিদা অস্বীকার করা যায় না-এমন বাস্তবতার মধ্যে গত ১৫ মে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, সময়ের প্রেক্ষাপটে জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তিত হওয়ার সূত্র ধরে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা পালন ও দায় গ্রহণের পরিধিও বদল হচ্ছে, একে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে দায়িত্বগ্রহণকারী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশি বেশি পেশাদারিত্ব আর সেবাবান্ধব হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা।
শিশুর জন্য ডে কেয়ার: ছয় বছর আগে নীরা যখন তার সন্তান অতলকে ডে-কেয়ার সেন্টারে রাখতে শুরু করেন, তখন চারপাশের অনেকেই এটাকে সহজভাবে নিতে পারেনি। সন্তানকে ডে-কেয়ারে রাখছে, ডে কেয়ারে দিচ্ছে-একটা নেতিবাচক ধারণা ছিল। এখন এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন নীরা। নীরা বলেন, বাড়িতে একজন ন্যানীর (আয়া) কাছে রাখার চেয়ে একটি দায়িত্বশীল ডে-কেয়ারে রাখা অনেক নিরাপদ। তবে ডে-কেয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি ক্লাইন্ডবান্ধব হওয়ার কথা বলেন তিনি। নীরার মতে, সবাই ৯টা-৫টা অফিস করেন না। রোজার সময় সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ডে-কেয়ার সেন্টার সেবা দেয়, কিন্তু যারা ব্যাংকে কিংবা গণমাধ্যমের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তারা ইচ্ছে করলেও সেই সময় বের হতে পারেন না। কোভিড-মহামারিতে ডে কেয়ার সেন্টারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, যাদের অফিস খোলা ছিল, তারা কিন্তু বেশ সমস্যার মুখোমুখি হন। আর একটা মহামারি হলে কী হবে? আমার মনে হয় ডে-কেয়ারগুলো তো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান নয়, তাই তাদের আরও বেশি ক্লাইন্ডদের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিতে হবে।’
প্রবীণনিবাসের প্রয়োজনীয়তা: আজিজুর রহমান একজন সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ হয়। বিরোধ এমন পর্যায়ে যায় যে, তার আর মন চায় না স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে থাকার। তাই ঢাকার এক প্রবীণনিবাসে তিনি থিতু হন। দেশের প্রথম প্রবীণনিবাসের প্রতিষ্ঠাতা খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল জানান, ‘৮০-৯০ শতাংশ প্রবীণ পরিবারের উপেক্ষা সইতে না পেরে চলে আসেন। আর অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় এখন এত বেশি যে, একজন মেয়ে কিংবা ছেলে ২০/৩০ হাজার টাকা বেতন পেয়ে সংসার চালিয়ে বাবা-মার জন্য একটি বেশি ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে পারেন না। তারাও তাদের বাবা-মাকে আমাদের এখানে রেখে যান। ঈদ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের নিয়ে যান। এমনই একজন গার্মেন্টস কর্মী তার মাকে রেখে গেছেন প্রবীণনিবাসে। প্রতিবার ঈদ করতে মাকে নিয়ে যান।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন মনে করেন, প্রবীণনিবাসকে নেতিবাচকভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই। অনেক পরিবারেরই প্রবীণকে দেখার মতো সুযোগ থাকে না। বাড়িতে কেউ থাকে না। যে কোনো সময় যে কোনো সমস্যাও হতে পারে। তাই তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও অনেক মানুষের সঙ্গে থাকার আনন্দের সুযোগ দিয়ে প্রবীণনিবাসে থাকাটা বরং ভালো।
দায়িত্বগুলো বদল হয়: আগের মতো ব্যাগ নিয়ে বাড়ির কর্তার বাজার করার চিত্রটাও বদলে গেছে বলে জানান ব্যাংকে চাকরি করা অনন্যা। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর অফিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়। তাই বিকালে অফিস করে আমিই আগোরা, স্বপ্ন, বিগবাজারের মতো রিটেল সপে বাজার করি। সময় কম হলে অনলাইনেও কেনাকাটা করি। দেখেশুনে ভালোমন্দ যাচাই করার সুযোগ নেই হয়তো, কিন্তু ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের মানও ভালো রাখে।’
বিবাদ এড়াতে সময়ের সঙ্গে চলা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, মানুষের কর্মব্যস্ততা, কর্মের কারণে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান ও উত্তরাধুনিক সময়ে মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধ পালনে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন মানুষকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। মানুষের আর্থিক ও অবস্থানগত পরিবর্তনের সঙ্গে পুঁজিবাদমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত যুক্ত হলে মানুষের সমবেত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রগুলো বদলে যায়। মানুষকে প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরতা সময়ের প্রেক্ষাপটে মানুষের ভূমিকা ও অবস্থানগত রূপান্তর। নানা আঙ্গিকে বিচার-বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকলেও পরিবর্তিত সময়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও মানুষকে পরিবর্তিত হয়ে নিজেদের সম্পর্কগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্র ও সুযোগের বণ্টন নির্ধারণ করতে হয়। অন্যথায়, পরস্পর দোষারোপ, হিংসাত্মক মনোভাব, আবেগগত জটিলতা ও ভূমিকা পালন নিয়ে পরস্পর প্রত্যাশার সংকট সৃষ্টি হবে, যা সমাজকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে। উন্নত বিশ্বে প্রবীণ ও শিশুদের দেখভালের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পেশাদারিত্ব বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করছে। বৈশ্বিক এই অবস্থাকে অনুসরণ করতে হবে। তবে নিজেদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামোর মূল উপজীব্য বজায় রেখে পরিবর্তিত ব্যবস্থায় পরিবর্তিত দায়িত্ব গ্রহণের মনোভাব থাকতে হবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *