দরিদ্র ও কোটিপতি দুটোই বাড়ছে

দরিদ্র ও কোটিপতি দুটোই বাড়ছে

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তেমনি সংকটকে পুঁজি করে বাড়ছে কোটিপতিও। সরকারি হিসাবে মানুষের মাথাপিছু আয়ের যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তার বড় অংশই নির্দিষ্ট কিছু মানুষের পকেটে যাচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্যে ও ছোট প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বৃহৎ শিল্পের হার বাড়ছে।
ফলে সামগ্রিকভাবে দেশে বাড়ছে বৈষম্য। বৈষম্যের বিষয়টি সরকারি বিভিন্ন তথ্যেও উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে বেশ কিছু মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগবে। আর পরিস্থিতির উত্তরণ না হলে সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য বেড়েছে। এটি শুধু আয়ে নয়, ভোগে, সম্পদে এবং সুযোগে রয়েছে বৈষম্য। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এই বৈষম্য ব্যাপক। এতে সরকারের নানা কর্মসূচি সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারছে না এবং বাল্য বিয়ে বাড়ছে। আগামীতে পুষ্টিহীনতা আসতে পারে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, যদি কোনো দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য খুবই প্রকট হয়, আয়ের বৈষম্য বাড়ে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যোগ হয়, তবে সে দেশে সামাজিক অসন্তোষ বাড়তে পারে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতিবাচক মিথস্ক্রিয়ায় সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়। ল্যাটিন আমেরিকাতে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় দুটি ধাক্কা এসেছে। প্রথমত করোনার কারণে সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমেছে। দ্বিতীয়ত ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আরেক দফা আঘাত এসেছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির ৯টি মৌলিক সূচকের ৮টিই নিম্নমুখী। এতে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। কিন্তু এর মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ সম্পদের দিক থেকে মোটা তাজা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের তথ্য অনুসারে করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনাকালে বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। ৯ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে তিন গুণ বেড়ে এটি ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে।
সিপিডি গবেষণা অনুসারে, করোনায় কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ও আয় কমেছে। ফলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
গত বছরের আগস্টে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার এলিজাহল ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনায় ৪৭ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে। পরিবারগুলোর ৭০ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অর্থাৎ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সব সংস্থার রিপোর্টই বলছে, দেশে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে।
অপরদিকে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যাও। চলতি ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে কোটিপতি ব্যাংকহিসাব ধারীর সংখ্যা ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯৭ জন। কিন্তু ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬ জন। এ হিসাবে তিন মাসে কোটিপতি বেড়েছে ১ হাজার ৬২১ জন। আর ২০২১ সালের মার্চ শেষে কোটিপতি হিসাবধারী বেড়ে ৯৪ হাজার ২৭২ জনে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এক দিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে, অন্য দিকে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। এর মানে হলো দেশে আয়ের বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। এটি অশুভ লক্ষণ। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এটি বন্ধ হলে কোটিপতি সংখ্যা আরও বাড়ত।
সরকারি তথ্য বলছে, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৫ জন। ১৯৭৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৭ জন। আর ১৯৭২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৩৬ বছরে দেশে কোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে ১৯ হাজার ১৫৮ জন, ২০০৮ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১২ বছরে তা ৭৪ হাজার ১২৭ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯০ জনে। অর্থাৎ ৩৬ বছরে যত জন বেড়েছে, ১২ বছরে বেড়েছে তার প্রায় ৫ গুণ। সরকারি হিসেবে দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে।
বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৫ মার্কিন ডলার। আর চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০৭ ডলার। এই আয়, উচ্চ মধ্যম আয়ের কাছাকাছি। এ ছাড়াও গত ৫ বছরে মাথাপিছু আয় প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু সঙ্গে পাল¬া দিয়ে বাড়ছে বৈষম্য। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু মানুষের আয় বাড়ছে।
এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, অর্থনীতিতে বড় সমস্যা হলো বৈষম্য। এই বৈষম্য কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তার মতে, কিছু ভিন্ন চিত্র রয়েছে। যেমন মাথাপিছু আয়ের অনুপাতে দেশে করদাতা বাড়ছে না। এখনো বাংলাদেশে কর জিডিপি অনুপাত, এখন যা আছে, তা দ্বিগুণ হতে পারে। তিনি বলেন, মাথাপিছু আয় বাড়লে করদাতা বাড়বে। কিন্তু সেটি বাড়ছে না।
জানা গেছে, মাথাপিছু আয়ের ৪টি খাত। কৃষি, শিল্প, সেবা এবং প্রবাসীদের আয় (রেমিট্যান্স)। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে রেমিট্যান্স যোগ করলে জাতীয় আয় পাওয়া যায়। আর জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। সরকারি হিসাবে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার। প্রতি ডলার ১০০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা ২ লাখ ৮২ হাজার টাকা। এ হিসাবে গড়ে একজন নাগরিক প্রতিমাসে ২৩ হাজার ৫০০ টাকার উপরে আয় করেন। তবে বিভিন্ন জরিপ বলছে বর্তমানে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য সর্বকালের সর্বোচ্চ।
অন্য দিকে করের হিসাবে বৈষম্য বোঝা যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। দেশে বতর্মানে দেশের করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) রয়েছে ৭৩ লাখ। আর মাত্র ২৩ লাখ মানুষ আয়কর দেয়। বর্তমানে কর আদায় জিডিপির ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। দক্ষিণএশিয়ায় যা সবচেয়ে কম। সিপিডির গবেষণা বলছে, দেশে বৃহৎ শিল্পের হার বাড়ছে। ২০১০ সালে জিডিপিতে বড় ও মাঝারি শিল্পের অংশগ্রহণ ছিল ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা ১৮ দশমিক ৩১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু ২০১০ সালে জিডিপিতে ক্ষুদ্র শিল্পের অংশগ্রহণ ছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ২০১৮ সালে তা মাত্র ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়েছে। এর অর্থ হলো, শিল্পখাত বড় ব্যবসায়ীদের দখলে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *