জীবন বাঁচাতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার
ডা. মো. তারেক ইমতিয়াজ (জয়): প্রায় শত বছর পূর্বে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং-এর পেনিসিলিন নামের এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়। এন্টিবায়োটিক এমন একটি ঔষধ যা মানবদেহে বিস্তার লাভ করা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে ব্যাকটেরিয়ার বংশবিস্তারকে রোধ করে।
একটা সময় ছিল যখন সামান্য কোনো ইনফেকশনেও মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তো। অনেকে মারাও যেত। কারণ, সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ঔষধ ছিল না। যক্ষার কথাই ধরা যাক। এক সময় একটা প্রবাদই ছিল যে, যার হয়েছে যক্ষা, তার নেই রক্ষা। কারণ, যার যক্ষা হতো, তার আর বাঁচার কোনো সম্ভাবনাই থাকতো না। একটা সময় ছিল, যখন কলেরা মহামারিতে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর সেরকম দৃশ্য দেখা যায় না। কারণ সেসব জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর ঔষধ এখন আমাদের হাতে আছে।
এন্টিবায়োটিক যেমন ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংঘটিত নানা রোগের চিকিৎসায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তেমনিভাবে ব্যাকটেরিয়াও তার নিজের বেঁচে থাকার জন্য এন্টিবায়োটিক যেন তার কোনো ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে নানারকম প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম। এভাবে ব্যাকটেরিয়া যদি কোনো এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে সফল হয়, তখন সেই এন্টিবায়োটিক সেই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আর কাজ করতে পারেনা। এই বিষয়টিকে বলা হয় এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (অহঃরনরড়ঃরপ ৎবংরংঃধহপব)। সুতরাং, মানব কল্যাণে এই এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের পাশাপাশি আমাদেরকে এই বিষয়েও সচেতন হওয়া উচিত যে ব্যাকটেরিয়া যেন এন্টিবায়োটিক এর বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করতে না পারে।
কিন্তু আমাদের অসাবধানতা ও অসচেতনতার কারণে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া সফলভাবেই এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে এই রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। যদি এভাবে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হতে থাকে।
আমাদের দেশে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হবার কারণ:
উন্নত বিশ্বে প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রয় করার বিধান না থাকলেও আমাদের দেশে এন্টিবায়োটিক যথেষ্ট সহজলভ্য। যে কেউ ওষুধের দোকানদারের কাছে গিয়ে প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক কিনতে চাইলেই তা কিনতে পারে। এভাবে এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার হবার সুযোগ বাড়ছে।
আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান না থাকা সত্তে¡ও অনেকেই চিকিৎসা পরামর্শ দেয়। আমাদের দেশে অনেকের কাছে ঔষধের দোকানদার মানেই ডাক্তার! দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় যে ঔষধের দোকানে গিয়ে রোগের উপসর্গ বলে ঔষধ চাইলে দোকানদার দিয়ে দিচ্ছে। যেখানে এন্টিবায়োটিক এর কোনো প্রয়োজনই নেই সেখানেও রোগীকে দেওয়া হচ্ছে এন্টিবায়োটিক! এভাবে এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহারই শুধু হচ্ছে না, পাশাপাশি রোগের সঠিক ডায়াগনোসিস না করে এভাবে ঔষুধ প্রয়োগ করায় রোগীও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও পড়ছে।
আবার সঠিক ডোজে এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে ঔষধ সেবন না করলেও এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে যক্ষা রোগের জন্য ৬ মাস মেয়াদে ঔষধ সেবন করার নিয়ম। কিন্তু কেও যদি ঔষধ শুরু করার কয়েক সপ্তাহ পরে কিছুটা সুস্থ বোধ করে এবং যক্ষার ঔষধ সেবন বন্ধ করে দেয়, তাহলে কিছুদিন পর আবার যক্ষার উপসর্গ দেখা দিবে এবং পরবর্তীতে এই যক্ষার ঔষধ পুনরায় শুরু করলেও সেই ঔষধ আর কাজ করবেনা। এভাবেই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়।
এন্টিবায়োটিকের এরকম যথেচ্ছা ব্যবহার এর ফলে ইতোমধ্যে এমোক্সিসিলিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিনসহ বেশ কিছু এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এসব এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে আগে যেখানে উপকার পাওয়া যেত, ইদানিং এরকম আরো অনেক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেও তেমন কোনো উপকার পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে এক সময় বেশিরভাগ এন্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। ফলে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ থাকা সত্তে¡ও মানুষ অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ বছর ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর পালিত হয়েছে বিশ্ব অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ-২০২২। বিশ্ব অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহ উপলক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে- “চৎবাবহঃরহম ধহঃরসরপৎড়নরধষ ৎবংরংঃধহপব ঃড়মবঃযবৎ” অর্থাৎ- এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে সকলে ঐক্যবদ্ধ হই। সুতরাং, আসুন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার খাতিরে আমরা এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হই এবং আমরা অঙ্গীকার করি যে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কখনো কোনো ঔষধ সেবন করবো না।
[লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), সহকারী রেজিস্ট্রার, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।]