রবীন্দ্র তিরোধানের ২০ বছর পরে ১৯৬১ সালে সংকলিত ‘বিচিত্র’ গ্রন্থের কিছু গান চিরকালের বিষয় হয়ে আছে। আমার কাছে প্রিয় গানটি ‘কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।’ এখানে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে নিজের জীবন এবং প্রকৃতিকে রবীন্দ্রনাথ এক অনাস্বাদিত পূর্বকথার মালায় গেঁথেছেন। তাঁর চাওয়া-পাওয়ার রক্তাক্ত ফিরিস্তি তাঁর জীবনীতে কোথায় আছে, তা আমাদের জানা নেই।
আমরা তাঁর রচিত গ্রন্থাদিতে যা পাই, সেই দৃষ্টিতে আমাদের বলার অভিপ্রায়।
জনতার অরণ্যে ১৮৬১ সালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। সেদিন ছিল ২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮ বঙ্গাব্দ, সোমবার। তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা দেবীর চতুর্দশ সন্তান এবং অষ্টম পুত্র।
লেখা বাহুল্য, সন্তানাধিক্যে জননী সারদা দেবীর সাহচর্য তাঁর জোটেনি প্রবলভাবে। ছেলেবেলা কেটেছে ভৃত্যদের দেখাশোনায়। এ ব্যাপারে ‘মাকে আমার মনে পড়ে’ ধারার কবিতায়, ‘জন্মকথা’, ‘বীরপুরুষ’ ‘লুকোচুরি’ ইত্যাদি কবিতায়, ‘শিশু’ (১৯১০), ‘শিশুভোলানাথ’ কাব্যে জননীর স্মৃতি মর্মরিত হয়েছে। উৎসর্গের ‘ছল’ কবিতায় ‘বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল’ অথবা ‘মরীচিকা’ কবিতায় ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।’ যা শেলির ‘স্কাইলার্ক’ কবিতার বিখ্যাত পঙক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয় (ঙঁৎ ংরহপবৎবংঃ ষড়ঁমযঃবৎ অথবা ডব ষড়ড়শ নবভড়ৎব ধহফ ধভঃবৎ)। তত দিনে জননীর তিরোধানের (১৮৭৫) ৩৫ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। আমরা এযাবৎ তাঁর ব্যক্তিজীবনের কোনো চিহ্ন দেখি না। তিনি কী চান তার হদিসও নেই। সুতরাং ‘কী পাইনি’ বলে গান রচনা করলেও সুখস্মৃতি যেন তাঁর জীবনকে দোলায়িত করেছে।
নিকটজনের একাধিক প্রিয় ব্যক্তির তিরোধান, সন্তান হারানোর বিয়োগব্যথায় কবি আকুল হননি তা নয়, তবে উদভ্রান্ত হননি। জীবন থেকে অনেক বসন্ত খসে গেছে। স্মৃতিতে মাঝে মাঝে আকুল হয়েছেন, কিন্তু হাত-পা ছেড়ে বসে পড়েননি। ১৯২৪ সালে নভেম্বর মাসের ২ তারিখ ‘পূরবী’ কাব্যের ‘কৃতজ্ঞ’ কবিতায় নিজের ভাগ্যের প্রতি দোষারোপ করেননি। ক্ষমা চেয়েছেন পারিপার্শ্বিকের কাছে এবং ঘোষণা করেছেন: ‘আমি তাই আমার ভাগ্যেরে ক্ষমা করি/যত দুঃখে যত শোকে দিন মোর দিয়েছে সে ভরি/সব ভুলে গিয়ে। পিপাসার জলপাত্র নিয়েছে সে/মুখ হতে, কতবার ছলনা করেছে হেসে হেসে/ভেঙেছে বিশ্বাস, অকস্মাৎ ডুবায়েছে ভরা তরী/তীরের সম্মুখে নিয়ে এসে-সব তার ক্ষমা করি।’ এই যে সীমাহীন ক্ষমার অঞ্জলি তিনি দিয়েছেন, সেখান থেকেই পূর্ণতা পেয়েছেন। সুতরাং অভিযোগ রাখবেন কোথায়!
না, অভিযোগ তেমন করেননি। বরং প্রশান্তি করে গেছেন অকৃপণভাবে। বলেছেন: ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব/ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব’ (গীতাঞ্জলি)। জীবনকে নব নব ভাবে না ভরলে জামাইদের কৃতজ্ঞতা বহন করে তিনি আমাদের মানস পরিচর্যার এত পাথেয় দিতে পারতেন না। বহু দুঃখ-সুখের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণ করে তিনি অশীতিবর্ষ যাপন করে গেছেন ‘মধুময় পৃথিবীর ধূলি’কে লালন করে। কী না পাওয়ার বেদনা তাঁকে উদ্বেল করেনি। ভাঁওতা দিয়ে পাঠককে ভোলাতে চাননি। আমরা তাঁর বোধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলতে পারি তিনি আফসোস করেছেন আমাদের পতনের জন্য, নিজের পরিণতির জন্য নয়।
দুঃখ-শোক-সন্তাপ সবার আছে, তবে রবীন্দ্রনাথের জীবনকে তা নতুন মাত্রা দিয়েছে তাঁর শেষ জীবনের কবিতাসম্ভারে। আজও আমাদের মনঃপ্রাণ পড়ে থাকে রবীন্দ্রবাণীর সুধা পানের জন্য। প্রতিটি ঋতুকে তিনি ছুঁয়ে গেছেন ‘কান্না হাসির দোল-দোলানো’ বাণীর মহিমা দিয়ে। সুতরাং নিজের শূন্যতায় অধীর হননি। আমরা তাঁর বাণীর বৈভবে আজও স্নাত। বিশ্ববাসীর চেতনায় তা অপাঙক্তেয় নয়। চিরনতুন-বাঙময়/জীবনের জয়ে পূর্ণ। কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘পূর্ণ হউক জীবনের জয়, পূর্ণ হউক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ জীবনের ব্যাপারে আমরাও রবীন্দ্র অনুরাগী হলে সবাই বলতে পারব ‘কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।’