ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ: একটা গল্প দিয়ে শুরু করছি। এক প্রেমিকা তার প্রেমিককে পরীক্ষা করার জন্য বলল, তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে চাই আমি! প্রেমিক বলল, কী পরীক্ষা নেবে? সব পরীক্ষার জন্য আমি প্রস্তুত। প্রেমিকা বলল, তোমার মায়ের হূিপণ্ডটা নিয়ে আসো। প্রেমে অন্ধ ছেলেটি ছুটল মায়ের কাছে! মাকে হত্যা করে তার হূিপণ্ড নিয়ে ছুটল প্রেমিকার কাছে, ভালোবাসার পরীক্ষায় পাশ করতে। পথে হঠাৎ আছড়ে পড়ল, আর হাত থেকে ফসকে গেল মায়ের হূিপণ্ডটা। হাতে তুলে নিতেই হূিপণ্ড থেকে আওয়াজ এলো, ‘ব্যথা পেলি খোকা? তুই তো খুব পিপাসার্ত, ক্লান্ত। আমি যে দাঁড়াতে পারছি না, তোকে কীভাবে পানি পান করাব বাবা!’ এরই নাম মা।
গত রবিবার ছিল বিশ্ব ‘মা’ দিবস। দিনটি কীভাবে, কবে, কোথা থেকে এলো, কেন পালন করা হয়, এর গুরুত্ব কী, তা হয়তো অনেকের অজানা। দিনটি পালনে রয়েছে এক ইতিহাস। ১৯০৭ সালের ১২ মে আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরে প্রথম বার ‘মাদারস ডে’ বা ‘মা দিবস’ পালিত হয়। ভার্জিনিয়ায় অ্যান নামে এক সমাজকর্মী ছিলেন। তিনি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতেন এবং ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে চেষ্টা এবং তাদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করতেন। অ্যানের একটি মেয়ে ছিল। একদিন মেয়ের সামনেই প্রার্থনা করেছিলেন, ‘যেন কেউ একটা দিন মায়েদের জন্য উৎসর্গ করেন।’ মায়ের সেই প্রার্থনা হূদয়ে নাড়া দিয়ে যায় তার মেয়েটির। অ্যানের মৃত্যুর পর সেই দিনকে সারা বিশ্বের প্রতিটি মায়ের জন্য উৎসর্গ করেন তার মেয়ে। আর এভাবেই মায়েদের প্রতি সম্মানে পালিত হয়ে আসছে মা দিবস। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে ‘মা দিবস’ ঘোষণা করেন। এর পর থেকে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়ে থাকে।
‘মা’ কথাটি সবচেয়ে ছোট অথচ সবচেয়ে মধুর একটি শব্দ। মাত্র এক অক্ষরে শব্দটি হলেও এর ব্যাপকতা সাগরের চেয়েও বিশাল। মায়ের মতো এত মধুর আর আবেগী শব্দ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। যে শব্দটিতে জড়িয়ে আছে স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা। ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, প্রতিটি সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা ও প্রেম স্বার্থহীন, সীমাহীন। সন্তানের জন্য মা বরাবরই নিঃস্বার্থ একজন মানুষ। মা হচ্ছেন মমতা-নিরাপত্তা-অস্তিত্ব, নিশ্চয়তা ও আশ্রয়। মা সন্তানের অভিভাবক, পরিচালক, ফিলোসফার, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও বড় বন্ধু। জীবনে সবচেয়ে বড? শ্রমজীবী হচ্ছেন মা, যার কর্মবিরতি নাই, মজুরি নাই, দাবি নাই, শর্ত নাই, স্বার্থ নাই, তিনি শুধু শ্রম দিয়েই যাচ্ছেন। তারই নাম মা। নিজের জীবনের চেয়েও সন্তানকে ভালোবাসেন, সন্তানের কথা ভাবেন। সন্তানের সামান্য ব্যথায় ব্যথিত হন। মা সব রোগের চিকিৎসক। মায়ের কাছে সবকিছু চাওয়া যায়। মা-ই একমাত্র ব্যক্তি, যার কাছে সবকিছু চাইলেই পাওয়া যায়। মা সবচেয়ে সেরা রাঁধুনি। মায়ের হাতের রান্না পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার। মা হলেন সন্তানের প্রথম বন্ধু, সেরা বন্ধু, চিরকালের বন্ধু। মায়ের মতো পরম বন্ধু এই জীবনে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গর্ভধারণের মুহূর্ত থেকেই সন্তানের সঙ্গে একজন মায়ের নিবিড় বন্ধন তৈরি হয়। বন্ধনটি আরো গভীর হয়, যখন তিনি সন্তানকে তার ঔরসে বহন, উষ্ণতা, পুষ্টি ও সুরক্ষা প্রদান করতে থাকেন। গর্ভাবস্থায় একজন মা তার অনাগত সন্তানের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন, যা তুলনাহীন। এই গভীরতা অন্য কারোর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এরপর শিশুটি যখন ভূমিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীতে আসে, তখন মা হয়ে যান তার প্রথম এবং সার্বক্ষণিক পরিচর্যাকারী। সন্তানের জন্য অগণিত রাতজাগা, সারাক্ষণ যতœ নেওয়া, খাওয়ানো এবং আদরের আলিঙ্গনের মাধ্যমে তিনি সীমাহীন ধৈর্য প্রদর্শন করেন।
শুধু মানুষ নয়, পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই তার মায়ের কাছে ঋণী। এই ঋণ শোধ করার কোনো বিকল্প নেই। চাওয়া-পাওয়ার এই পৃথিবীতে মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না।
মাকে নিয়ে কিছু অসাধারণ উক্তি : মাকে নিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিরা হাজারো অসাধারণ উক্তি করেছেন।
(১) মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।
(২) রবীন্দ্রনাথের গানে ‘মধুর আমার মায়ের হাসি, চাঁদের মুখে ঝরে……, সে যে জড়িয়ে আছে ছড়িয়ে আছে সন্ধ্যা রাতের তারায়, সেই যে আমার মা, বিশ্বভুবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা….,’।
(৩) আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, ‘যার মা আছে, সে কখনোই গরিব নয়।’
(৪) বিখ্যাত ফুটবলার দিয়াগো ম্যারাডোনা বলেছেন, ‘আমার মা মনে করেন আমিই সেরা, আর মা মনে করেন বলেই আমি সেরা হয়ে গড়ে উঠেছি।’
(৫) জর্জ ওয়াশিংটন বলেছেন, ‘আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী হলেন আমার মা।’ মায়ের কাছে আমি চিরঋণী। আমার জীবনের সব অর্জন তারই কাছ থেকে পাওয়া নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা আর শিক্ষার ফল।
(৬) মাইকেল জ্যাকসন বলেছেন, ‘আমার মা বিস্ময়কর, আর আমার কাছে উৎকৃষ্টের আরেক নাম।’
(৭) কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘মা হলো পৃথিবীর একমাত্র ব্যাংক, যেখানে আমরা আমাদের সব দুঃখ, কষ্ট জমা রাখি এবং বিনিময়ে নিই বিনা সুদে অকৃত্রিম ভালোবাসা।’
(৮) কবি কাদের নেওয়াজ বলেছেন, ‘মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই, ইহার চেয়ে নামটি মধুর, তিন ভুবনে নাই…।’
(৯) কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘যেখানেতে দেখি যাহা, মা এর মত আহা, একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই, মায়ের মতন এত আদর সোহাগ সে তো, আর কোনোখানে কেহ পাইবে না ভাই।’
(১০) শিল্পী ফকির আলমগীরের ভাষায়, ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না, এমন দরদি ভবে কেউ হবে না আমার মা গো।’
ইসলাম মাকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম করা হয়েছে মাকে। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ তাই জান্নাত পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকারী কোনো সন্তানই মাকে এরিয়ে যেতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমার পরওয়ারদেগার আদেশ করিয়াছেন যে, তোমরা তাহাকে ব্যতীত অন্য কাহারও এবাদত করিও না এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করিও। যদি তোমার সম্মুখে তাহাদের একজন অথবা উভয়ে বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাহাদিগকে উহ পর্যন্ত বলিও না, আর তাহাদিগকে ধমক দিও না এবং তাহাদের সঙ্গে খুব আদবের সহিত কথা বলিও। এবং তাহাদের সম্মুখে করুণভাবে বিনয়ের সহিত নত থাকিবে, আর এইরূপ দোয়া করিতে থাকিবে-হে আমার পরওয়ারদেগার! তাহাদের উভয়ের প্রতি দয়া করুন, যেইরূপ তাহারা আমাকে লালন-পালন করিয়াছেন শৈশবকালে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৩-২৪)
পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে হাদিসেও বহু জায়গায় বর্ণনা এসেছে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া অবশ্যই কবুল হয়; এতে কোনো সন্দেহ নেই। এক. মা-বাবার দোয়া তার সন্তানের জন্য; দুই. মুসাফিরের দোয়া ও তিন. অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া অত্যাচারীর বিরুদ্ধে।’ (আবু দাউদ-১৫৩৮) রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মা-বাবাই হলো তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম।’ (ইবনে মাজাহ মিশকাত, পৃষ্ঠা ৪২১)
মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব: সন্তানের সব সময় মনে রাখা উচিত, মায়ের ত্যাগের কারণেই সে এই সুন্দর পৃথিবীতে এসেছে। যদি সে মাকে ভুলে যায়, কষ্ট দেয় বা অবহেলা করে, তাহলে সবই মিছে। সন্তানের পর্বতসমান সফলতা তখন মূল্যহীন। কিন্তু অতি দুঃখের সঙ্গে লিখতে হচ্ছে, সেই মহান মায়ের প্রতি অনেক সন্তান আজকাল উদাসীন, অনেকে বেপরোয়া। এমনও শোনা যায়, সন্তান তার মাকে প্রহার করছেন, ঘর থেকে বের করে দিচ্ছেন, জঙ্গলে মাকে ফেলে এসেছেন, নিজে সুন্দর ঘরবাড়িতে বাস করে মাকে রেখেছেন রান্নাঘরে।
মা শ্রদ্ধার আধার, স্নেহের কান্ডারি। সব ধর্মেই মা আশীর্বাদস্বরূপ। তাই সন্তানের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে মাকে শ্রদ্ধা করা, অন্তরের শ্রেষ্ঠতম আসনে তাকে প্রতিষ্ঠা করা, ভক্তি ও শ্রদ্ধায় মাকে অভিষিক্ত করা। সন্তানের কাছে মা-ই হলেন জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাই মায়ের সঙ্গে সর্বদা সম্মানজনক ও সহযোগিতামূলক ব্যবহার করতে হবে। মায়ের অবাধ্যতা অমার্জনীয় অপরাধ। মায়ের আদেশ পালন করা এবং তার নির্দেশ মেনে চলা সন্তানের পবিত্র কর্তব্য। পৃথিবীর সবচেয়ে আপন হলেন মা।
তাই আসুন, আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, আমরা আমাদের কোনো আচরণে যেন মাকে কষ্ট না দিই। যাদের মা এখনো বেঁচে আছেন, সেই মায়ের জন্য জীবনের সর্বোচ্চটাই করার চেষ্টা করি।