ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
জাপান বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দু-তিনটি দেশের একটি। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ। ৫২ বছরের ব্যবধানে এখন মধ্য আয়ের দেশের কাতারে স্থিতি করার চেষ্টা চলছে। জাপান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বাংলাদেশও মুক্তিযুদ্ধের পর পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। জাপান রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো ভস্ম থেকে উড়াল দেওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। জাপানের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে বাংলাদেশের। এ প্রেক্ষাপটে জাপানিদের মনোজগৎ নিয়ে আজকের লেখা।
টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসে আমার জাপানি দোভাষী ছিলেন ইসামু শিরাই। সত্তরোর্ধ্ব শিরাই সান (জাপানিরা পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সবাইকে সান সম্বোধন করে থাকে) বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল উইংয়ে ছিলেন প্রায় দেড় যুগ। তার আগে দীর্ঘ ৩৫ বছর আমেরিকান দূতাবাসের ট্রেড উইংয়ে এবং তারপর একটি জাপানি বড় করপোরেশনে আট বছরের কাজ করার আলোকিত অভিজ্ঞতা তাঁর। শুধু দোভাষী নন, জাপানে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রসারে আর বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ আকর্ষণের কাজে তিনি মূলত কমার্শিয়াল কাউন্সিলরের বিশেষ সহযোগীর ভূমিকাই পালন করতেন। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন বাণিজ্য ডেলিগেশনে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যারা জাপানে আসতেন তারা সবাই স্বীকার করতেন শিরাই সানের নিবেদিত নিষ্ঠার।
শিরাই সানের দায়িত্ব সচেতনতা ও সযতœ কর্মপ্রয়াসের মধ্যে জাপানিদের জাত্যভিমান আর ব্যক্তিত্বের পরিচয় যেমন পাই, তার সমন্বয়ধর্মী মানসিকতার মধ্যে অনুসন্ধান করি জাপানিদের জীবন বৈশিষ্ট্যের। বিভিন্ন সময়, পর্যায় ও পরিস্থিতিতে তার আচার-আচরণে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জাপানিদের মনের কথা অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছি।
জাপানি সমাজে প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের রয়েছে সম্মান ও সমীহ। তারা পারতপক্ষে বিবাদ সৃষ্টি পছন্দ করে না। রবীন্দ্রনাথ ‘জাপান যাত্রীর পত্রে’ আজ থেকে ১০৭ বছর আগে যেমনটি লিখেছিলেন- ‘জাপানি বাজে চেঁচামেচি ঝগড়াঝাটি করে নিজের বল ক্ষয় করে না। প্রাণশক্তির বাজে খরচ নেই বলে প্রয়োজনের সময় টানাটানি পড়ে না। শরীর মনের এ শান্তি ও সহিষ্ণুতা ওদের স্বজাতীয় সাধনার একটা অঙ্গ।’ দেউলিয়া হয়ে যাওয়া একটি কোম্পানির কাছে জাপানের একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন প্রকাশ বাবদ কিছু পাওনা বাকি ছিল। কোম্পানিটির নতুন মালিকের কাছে পত্রিকাটি পাওনা দাবি করলে তারা কোনো লিখিত চুক্তি না থাকায় ওই পাওনা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানায়। দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কোম্পানিটির সঙ্গে বিশ্বাসের ভিত্তিতে বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছিল। জাপানে অধিকাংশ লেনদেন বিশ্বাসের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এ বিশ্বাস যে কোনো মূল্যে রক্ষাও করা হয়ে থাকে। লেনদেনের পরিমাণ বেশি না হলে সাধারণত লেখালেখিতে যায় না কেউ। লেখালেখি করতে চাইলে অপর পক্ষ মনে করতে পারে যে তাদের বিশ্বাস করা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে লেনদেন বা ব্যবসা না-ও হতে পারে। আইনের অশ্রয় বা অন্য কোনো বাগবিতন্ডার পদ্ধতিতে না গিয়ে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিল যে, কোম্পানিটির নতুন মালিকপক্ষের অনুরূপ পরিমাণ বিজ্ঞাপন ভবিষ্যতে বিনামূল্যে প্রকাশ করা হবে যদি তারা বকেয়া পরিশোধে সম্মত থাকে। কোম্পানিটি এতে রাজি হলো। ভবিষ্যতে বিনামূল্যে তাদের বিজ্ঞাপন ছাপা হবে এটি হলো তাদের মুখ রক্ষা। আর পত্রিকাটি দেখল তাদের বকেয়া পাওনার জন্য তারা ভিন্নতর বাড়াবাড়ি বা আইনের আশ্রয় নিলে হয়তো টাকা পেত, কিন্তু কোম্পানিটির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেত চিরতরে। এক্ষণে বকেয়া টাকা পাওয়া গেল ভবিষ্যতে বিনামূল্যে কিছু বিজ্ঞাপন ছাপানোর বিনিময়ে। মুখ্য লাভ হলো উভয়ের সন্তোষজনক সম্মতিতে বিষয়টি নিষ্পত্তি ঘটায় উভয়ের মধ্যে ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় থাকল।
আরেকটি উদাহরণ। জাপানে বসবাসকারী বিদেশিদের মধ্যে এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়। বিদেশি নাগরিকদের ৮টি দল এ ম্যাচে অংশ নেয়। শেষমেশ আফ্রিকা ও আইরিশ দল ফাইনালে যায়। দুই দলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা। খেলার প্রথমার্ধে ফলাফল গোলশূন্য। দ্বিতীয়ার্ধের ১৫ মিনিট পর খেলা হিংস্র আকার ধারণ করে। কানাডিয়ান রেফারি আফ্রিকার এক খেলোয়াড়কে লালকার্ড দেখিয়ে বহিষ্কার করেন। এটি চরম বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ আখ্যা দিয়ে আফ্রিকার খেলোয়াড়রা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এবং খেলায় চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসে। আফ্রিকানরা এক পর্যায়ে খেলা বর্জনের হুমকি দেয়। প্রীতি ফুটবল আয়োজক জাপানিরা দেখলেন পুরো ব্যাপারটা অত্যন্ত নাজুক এবং দুঃখজনক পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে। আফ্রিকানরা দাবি করছে, তাদের খেলোয়াড়কে বহিষ্কার করা যাবে না, পক্ষান্তরে কানাডিয়ান রেফারি তার সিদ্ধান্তে অনড়। পরিস্থিতি সামাল দিতে জাপানি আয়োজকরা এমন একটা সিদ্ধান্তে এলেন যে, রেফারিকে অনুরোধ করা হবে আফ্রিকান দলের ক্ষমা চাওয়ার শর্তে লালকার্ড প্রদর্শনের সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করতে। আফ্রিকান দলের ক্যাপ্টেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্ষমা চাইলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে তারা বাকি খেলায় বেপরোয়া আচরণ করবেন না। কানাডিয়ান রেফারি তবুও অনড়। আফ্রিকান ক্যাপ্টেন ক্ষমা চাওয়ার শর্ত না মানার হুমকি দিলেন। শেষমেশ আয়োজকদের এক কর্তাব্যক্তি নিজে রেফারির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলেন- প্রতিপক্ষ আইরিশ দলও রেফারিকে তা মেনে নিতে অনুরোধ করল। রেফারি মেনে নিলেন। খেলা সুন্দর মতো এগিয়ে গেল।
জাপানে কেউই তাদের বিবাদকে চূড়ান্তে নিয়ে যেতে দিতে চায় না। সব সময় চেষ্টা চলে সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছাতে-যাতে সবার মুখ রক্ষা হয়। এমন সিদ্ধান্তে সবাই উপনীত হতে চায় যা বিবাদের সময় সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য বা সবাই সম্মত হয়। প্রত্যেক পক্ষ যেন ভাবে তাদের জয় হয়েছে। কেননা কেউ পরাজিত বা উপেক্ষিত হয়েছে ভাবলে তারা হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে, যা কাম্য নয়। ব্যক্তির মর্যাদাকে জাপানিরা সম্মান ও সমীহ করতে জানে। তারা কাউকে চূড়ান্তভাবে বৈরী ভাবতে চায় না। বিবাদ-বিসংবাদ কিংবা আলাপ-আলোচনা বা নেগোসিয়েশনে তারা এমন এক পর্যায়ে এসে থামা পছন্দ করে যেখানে সমাধানে পৌঁছানো না গেলেও কিংবা আলোচনা ভেঙে গেলেও যেন সমঝোতা বা ঐকমত্যের সম্ভাবনা পুরোপুরি তিরোহিত না হয়ে যায়। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী জাপানিরা সব ব্যাপারে সমন্বয় ও সহনশীলতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং আচার-আচরণে এমন ভাব বজায় রাখে যাতে সবাই তার নিজের অবস্থানে আস্থাবান থাকতে পারে। গৌতম বুদ্ধের আরেক দর্শন হলো দোষে-গুণে মানুষ। একজন মানুষ পুরোপুরি মন্দ নয় আবার তার পক্ষে সম্পূর্ণ ভালো হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং ভালোমন্দের সমন্বয় সাধনে একজন মানুষের উচিত এটা দেখা যে ভালোর পাল্লা যাতে ভারী হয়। ১০টা ভালো কাজ করে ৮টা মন্দ কাজের সঙ্গে ব্যালান্স করাটাকে তারা গুরুত্ব দেয়।
ব্যালান্স করার ব্যাপারটাকে তারা দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও মেনে চলে। জাপানের প্রত্যেক ব্যক্তির জানা আছে প্রতিদিন তার কত ক্যালরির খাবার খাওয়া উচিত। এটা যাতে সে নিয়মিত মেনে চলতে পারে সে জন্য তারা সেট মেনু বা প্যাকেজ খাবার গ্রহণ করে থাকে। জাপানিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাইরের খাবার খেয়ে থাকে। ঘরে খাবার তৈরিতে সময়, স্পেস ও ইউটিলিটি খরচকে তারা তুলনামূলকভাবে নন-ইকোনমিক মনে করে। প্রতি বেলার মানসম্মত ও মান নিয়ন্ত্রিত খাবার সরবরাহের দোকান যত্রতত্র রয়েছে। এসব দোকানে সেট মেনু বাইরে ডিসপ্লে করা থাকে। মেনডিশ, সাইডডিশ, সবজি, সালাদ, ফল বা মিষ্টি সবই পরিমাণ মতো (প্লাস্টিকের তৈরি হুবহু দেখতে) সেট মেনু বাক্সে সাজানো থাকবে। ডিসপ্লে করা প্রতি সেটে খাবারের দাম এবং এ খাবারগুলোর ফুড ভ্যালু বা ক্যালরির পরিমাণ উল্লেখ করা থাকে। শিরাই সানের বয়স ৭৫ বছর। তাঁর লো প্রেসার, ডায়াবেটিস নেই, ওজন ৫৭ কেজি, উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। চিকিৎসক এসব দেখে বলে দিয়েছেন প্রতিদিন তাঁর এখন ১৯০০-১৯৫০ ক্যালরির খাবার খাওয়া উচিত। শিরাই সান সকালে গরম জাউভাত মিসো স্যুপ, মুলা সেদ্ধ আর গ্রিন টি খেয়ে আসেন, যার একুনে ফুড ভ্যালু ৩৫০ ক্যালরির মতো। দুপুরে দূতাবাসের পাশে যে কোনো খাবারের দোকান থেকে ১০০০ কিংবা ১১০০ ক্যালরির লাঞ্চ বক্স কিনে খাবেন। ডিনারে তিনি হিসাব করে (১৯০০- (৩৫০+১১০০)= ৪৫০ ক্যালরি সম্পন্ন সেট মেনু বেছে নেবেন এবং খাবেন। ডিনার কিংবা লাঞ্চে যদি কোনো আনুষ্ঠানিক দাওয়াতে তাকে যেতে হয় তাহলে তদানুযায়ী তিনি সমন্বয় করে নেবেন অপর বেলার খাবার যাতে সারা দিনে মোট পরিমাণ ১৯০০-১৯৫০ ক্যালরির মধ্যে সীমিত থাকে।
সারাজীবন তিনি এটা মেনে চলেছেন বলেই সে সময় পর্যন্ত মোট ৫৫ বছর চাকরি করার পরও পঁচাত্তর বয়সী শিরাই সান তখনো ছিলেন দিব্যি কর্মক্ষম। তাঁর চুলে পাক ধরেনি এবং আমার সঙ্গে সেই ১৯৯৭ সালে ৭০ বছর বয়সী শিরাই সানের বয়সে ২৫ বছর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও মনে হতো তিনি আর আমি সমবয়সী। (শিরাই সান ৯৪ বছর বয়সে ২০২১ সালে টোকিওতে মারা যান। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি) জাপানিদের গড় আয়ু বর্তমানে ৮২ বছর। তার আরেকটি অন্যতম কারণ আমার মতে তিনবেলা খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতায় তাঁদের অয়োময় দৃঢ়তা। সকাল ৭টায় ব্রেকফাস্ট, দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে লাঞ্চ এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে ডিনার তারা করবেই। সম্রাটকে জাপানিরা খুব সম্মান করে। নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য গ্রহণকে তারা এতটা পবিত্র দায়িত্বজ্ঞান করে যে, ভাবখানা যেন ঠিক ওই সময় তাদের সম্রাটও খাবার বাক্স খুলেছেন। আমরা জোক করতাম সমুদ্র সীমান্তে দায়িত্ব পালনরত জাপানি পুলিশ যথাসময় লাঞ্চ করাকে এত গুরুত্ব দেয় যে, ঠিক ওই সময় বিদেশি ইমিগ্র্যান্টরা বেআইনিভাবে তাদের সামনে দিয়ে জাপানে ঢুকলেও তারা কোনো বাধা দেবে না।