মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান: ৪৬০ কোটি বছর আগের মহাকাশের একটি ছবি নাসা প্রকাশ করে। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড অর্থাৎ ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড আগে আলো সূর্য থেকে বের হয়েছে। তার মানে ৪৬০ কোটি বছর আগে আলো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সম্প্রতি নাসার টেলিস্কোপে এসে প্রতিফলিত হয়। নাসার প্রকাশিত অনেক ছবিতেই মহাকাশে আলোকিত ছোট বড় অনেক ফোঁটা দেখা যায়। আলোকিত ফোঁটাগুলো এক একটি গ্যালাক্সি। মিল্কিওয়ে এমনই একটি গ্যালাক্সি যেখানে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীসহ অনেকগুলো গ্রহ অবিরত ঘুরছে। মহাকাশের এইসব কিছুর মাঝে পৃথিবীকে একটি বিন্দুর মতোই মনে হয়। আর সবার মাঝে আদম সন্তান শ্রেষ্ঠ জীব।
জীবন-জীবিকার অতি গতিময়তা আর বিজ্ঞানের বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডে প্রকৃতির শৃঙ্খল এখন ভেঙে পড়ার উপক্রম। বায়ুমণ্ডলের মাঝে দেখা দিয়েছে ভারসাম্যহীনতা। ওজনস্তরের নিজস্ব শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। ফলে তাপমাত্রা এখন মাথাব্যথার কারণ। অনেকে বলেন গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কথা। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণে কুল পাচ্ছে না জীবকুল। সমন্বয় হারাচ্ছে মাটি পানি আর আবহাওয়া। ফলে কৃষিজ উৎপাদনে চরম বিপর্যয় ঘটেছে। কোথাও খরা, কোথাও বন্যা কিংবা সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাবকেই ইঙ্গিত করছেন বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাস্ট্রের ওসেনিক অ্যান্ড এটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) এবং ভারতের মনসুন মিশন ক্লাইমেট ফোরকাস্ট সিস্টেমের (এমএমসিএফএস) যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে-২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রশান্ত মহামসাগরের ওপর বিরাজমান ‘এল নিনো’ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকছে। আর এ ঘটনাটিকে অদ্ভুত বলে মন্তব্য করেছেন বিজ্ঞানীরা। সাধারণত প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষীয় অঞলে ৫ থেকে ৮ বছর পরপর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে এক ব্যতিক্রমী স্রোতের সৃষ্টি হয়। এই উষ্ণ স্রোতটি নিরক্ষীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাংশে শীতল পানি অপসারণ করে এর স্থান দখল করে নেয়। ফলে বায়ুবীয় গোলযোগের সৃষ্টি হয়। ‘এল নিনো’র বিপরীত অবস্থা হলো ‘লা নিনো’।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ‘এল নিনো’ এবং ‘লা নিনো’র উদ্ভব ঘটছে প্রকৃতিতে। ফলে বন্যা, খরা, দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ঘটনাটি কি দৈবাৎ? আমরা জানি অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনই এর মূল কারণ। চলে আসে শিল্প বিপ্লবের কথা। বিষয়টি এখন স্পষ্ট। আইপিসিসি (ইন্টার গভরমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ)-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ বাযুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনীভূত মাত্রা হবে ৪০৫-৪৬০ পিপিএম, বৈশ্বিক উষ্ণতার পরিবর্তন ০.৪-১.১ ডিগ্রি সেন্টিমিটার এবং সমুদ্র সমতলের গড় উষ্ণতা বাড়বে ৩-১৪ সেন্টিমিটার। গত কয়েক মাস ধরে পূর্ণিমার জোয়ারে দেশের উপকূলের অধিকাংশ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। আভ্যন্তরীণ মিঠা পানিতে লবণ-পানির অনুপ্রবেশের স্থায়িত্ব বাড়ছে। বরিশালের কিছু জায়গায় মিঠা পানির জলাভূমিতে লবণাক্তার উপস্থিতির কথা শোনা যাচ্ছে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় রুই জাতীয় মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সুন্দরবনের অনেক জায়গাতে জোয়ারের পানি আটকে থাকছে এবং সেখানকার পশুপাখির বিরূপ চিৎকারও এলাকার লোকজনের কানে এসেছে।
বর্তমানে ছয় ঋতুর বাংলাদেশ আর বলা যাচ্ছে না। অনেকের মতে, ঋতুচক্র মানুষের খপ্পরে পড়ে দুষ্টচক্রে পরিণত হয়েছে অর্থাৎ প্রকৃতির বিরূপ আচরণ মানুষের বিরূপ আচণেরই প্রতিশোধ। পরিবেশবাদীরা বলছেন মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। একদিকে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ আর অন্যদিকে প্রকৃতিকে ইচ্ছামতো নির্যাতনের ফলাফল জলবায়ু পরিবর্তনে এই হাল হকিকত। একটি ভরা মৌসুম যেখানে খাল-বিল-ডোবা-নালা পানিতে টইটুম্বুর হওয়ার কথা, সেখানে পানির জন্য হাহাকার। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের গোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জ রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।
জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন বিষয়ক দপ্তরের তথ্য মতে, চলতি দশক অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে দুর্যোগের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৪৬০টি যা দৈনিক দুটির কাছাকাছি। সংস্থাটি বলছে সর্বশেষ দুই দশকে প্রতিবছর ৩৫০-৪০০টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ দুর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ্ববাসী। উন্নত দেশের অতি বিলাসিতা আর দরিদ্র দেশের চরম অভাব বৈশ্বিক বৈষম্য চরম মাত্রায় পৌঁছতে পারে। ফলে জীবন-জীবিকার বিকল্প সন্ধানে প্রকৃতির প্রতি নির্যাতন বেশি মাত্রায় বেড়ে যেতে পারে। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা কি প্রস্তুত?