অনলাইন ডেস্ক: প্রথমবারের মতো চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে যাননামিয়ে ইতিহাস গড়ল ভারত। এর আগে চাঁদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছে মাত্র তিনটি দেশ-যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার পূর্বসূরি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। তিন দেশের যানই নেমেছে পৃথিবীর উপগ্রহটির নিরক্ষীয় অঞ্চলে। দক্ষিণে অবতরণ করায় ভারতের জন্য এই সাফল্য তাই বাড়তি তাৎপর্য বহন করছে।
ভারতীয় সময় গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩৪ মিনিট) রোভার ‘প্রজ্ঞান’ বহন করা ল্যান্ডার যান ‘বিক্রম’ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে স্বাভাবিক গতিতে (সফট) অবতরণ করে। চন্দ্রযানের অবতরণ সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল এবং ডিডি (দূরদর্শন) ন্যাশনাল চ্যানেলের মাধ্যমে।
১৯ মিনিটের সফল অবতরণের পরই কাজ শুরু করে দিয়েছে চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে তোলা ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে ইসরোর সদর দপ্তরে।
ইসরোর এক টুইট বার্তায় বলা হয়েছে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে বিক্রমের অবতরণ প্রক্রিয়ার শেষ ধাপের সেই ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। ইসরোর ওয়ার রুমের সঙ্গে বিক্রমের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয়েছে।
ভারতের চন্দ্রাভিযানের এই বিরাট সাফল্যে আনন্দানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘চন্দ্রপৃষ্ঠে ভারত।’ তিনি বলেন, ‘আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় আছি; তবে আমার মনটা চন্দ্রযান মিশনের সঙ্গেই আছে।
আমরা নতুন ভারতের নতুন যাত্রার সাক্ষী। নতুন ইতিহাস লেখা হলো। এর আগে কোনো দেশই সেখানে (চাঁদের দক্ষিণ মেরু) পৌঁছতে পারেনি। আমাদের বিজ্ঞানীদের কঠোর পরিশ্রমে আমরা সেখানে পৌঁছতে পেরেছি।’
নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘এই মিশনের সফলতা ভারতকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।
কিভাবে আমরা ব্যর্থতা থেকে শিখে চূড়ান্ত সফলতা লাভ করি, তার প্রমাণ দিল এই অভিযান।’ তিনি বলেন, ‘টিম চন্দ্রযানকে আমার শুভেচ্ছা। তাঁরা এই মুহূর্তটির জন্য বছরের পর বছর পরিশ্রম করেছেন। দেশের ১৪০ কোটি মানুষকে শুভেচ্ছা।’
চন্দ্রযান-৩-এর অভিযানের শেষ মুহূর্তগুলো দেখতে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষায় ছিল শতকোটি ভারতীয় এবং বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানে আগ্রহীসহ অগণিত মানুষ। সাফল্য কামনা করে গত বুধবার সমান উৎসাহের সঙ্গে পার্টি ও প্রার্থনা চলে।
ভারতের বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান-৩-এর চাঁদের মাটি স্পর্শ করার আগের ২০ মিনিটকে ‘২০ মিনিটের আতঙ্ক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছেন, সম্ভাব্য সব ধরনের সমস্যা হলেও নিরাপদে চাঁদের মাটিতে নামা নিশ্চিত করতে পারবেন বলেই তাঁদের প্রত্যাশা।
ভারতীয় মহাকাশ অভিযানের এ পর্যন্ত সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় ঘটনাটির জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা রাখা হয় দেশটির স্কুলগুলো। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনলাইনে চন্দ্রযানের অবতরণ পর্যবেক্ষণ করেন।
গত রবিবারই অবতরণের সময় চাঁদের পৃষ্ঠে বিধ্বস্ত হয় রাশিয়ার চন্দ্র অভিযানের যান লুনা-২৫। রুশ অভিযানের ব্যর্থতার কারণে ভারতের চন্দ্রযান নিয়ে দম বন্ধ করা অবস্থাটি আরো বেড়ে যায়।
২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২ অভিযানটির যান চাঁদের একই এলাকায় নিরাপদে অবতরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এলাকাটি গর্ত এবং গভীর খাদে ভরা।
ইসরো আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করে বলে আসছিল, চন্দ্রযান-৩ কোনো বাধাবিঘœ ছাড়াই অবতরণ করতে পারবে। তাদের বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান-২-এর ব্যর্থতা থেকে যেসব মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা এবার বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
অবতরণের স্থানটি খুব যত্নসহকারে নির্বাচন করা হয়েছে। এলাকাটিতে অতীত অভিযানে পানির সূক্ষ্ম চিহ্ন পাওয়া গেছে। আশা করা হচ্ছে, সেখানে বরফ আকারে পানি থাকতে পারে। এটি হতে পারে এক বিশাল মূল্যবান সম্পদ। চাঁদে মানুষের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান এবং ভবিষ্যতে মঙ্গলসহ দূর মহাকাশে অভিযানের জন্য এই পানি কাজে লাগতে পারে। ২০০৯ সালে ইসরোর চন্দ্রযান-১ অভিযানের যানে থাকা নাসার একটি যন্ত্র চাঁদের পৃষ্ঠে পানির অস্তিত্ব শনাক্ত করেছিল। ২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতার জন্য প্রচণ্ড গতিতে নেমে চাঁদের বুকে ধ্বংস হয়েছিল।
চাঁদের বুকে পানির উপস্থিতি ভবিষ্যতের চাঁদ অভিযানের জন্য আশা জোগাবে। এটি সেখানে পানীয় জলের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম শীতল করতে এবং অক্সিজেন উৎপাদন করতেও কাজে লাগানো যেতে পারে ওই পানি। এটি মহাসাগরের উৎস সম্পর্কেও সূত্র জোগাতে পারে।
রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরে ভারত হচ্ছে চাঁদে নিরাপদে যান ও রোভার অবতরণ করা চতুর্থ দেশ। মঙ্গলবার ইসরো বলেছিল, মিশনটি সময়সূচিমতোই চলছে। সিস্টেমগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে। ইসরো এরই মধ্যে কাছ থেকে তোলা চাঁদের বিভিন্ন ছবিও প্রকাশ করেছে।
চন্দ্রযান-৩ অভিযানে চাঁদে নামার যানটি ১৪ জুলাই মহাকাশে উৎক্ষপণ করা হয়েছিল। একটি এলভিএম-৩ হেভি-লিফট রকেট দিয়ে এটি উৎক্ষপণ করা হয়। পৃথিবীর কক্ষপথে কয়েকবার ঘোরার পর এটি ৫ আগস্ট চাঁদের কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছিল।
ল্যান্ডার বিক্রমের নামকরণ করা হয়েছে ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচির জনক বিক্রম সারাভাইয়ের নামে। চাঁদের এই অভিযানের পরে ইসরোর কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সূর্য নিয়ে গবেষণা মিশন ‘আদিত্য-এল-১’ এবং মানববাহী মহাকাশ যান কর্মসূচি ‘গগনযান’। ‘আদিত্য-এল-১’ হচ্ছে সূর্য নিয়ে গবেষণা করার জন্য ভারতের প্রথম মহাকাশভিত্তিক মানমন্দির। খুব সম্ভবত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এটি উৎক্ষপণের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।