চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নাজমুন নাহার জেমি
১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়। প্রথম শিল্পবিপ্লবের দ্বারা ইংল্যান্ড তথা সমগ্র বিশ্বে উৎপাদনব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব শুরু হয় যা উৎপাদনে এক নতুন গতির সঞ্চার করে। ফলে উৎপাদনব্যবস্থায় শিল্পকারখানাগুলো তড়িৎ ও অ্যাসেম্বলি লাইনের মাধ্যমে ব্যাপক উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করে। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কার তৃতীয় শিল্পবিপ্লবকে চূড়ান্ত গতি দান করে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লব বিশ্বকে একটি গ্রামে পরিণত করে। ফলে উৎপাদনব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়। তবে বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আগের তিন বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। চলমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি হলো প্রযুক্তি। ক্ষুদ্র ও শক্তিশালী সেনসর, মোবাইল ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেশিন লার্নিং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভরশক্তি। এ বিপ্লবে মেশিনকে বুদ্ধিমান করে তৈরি করা হচ্ছে। মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং, রোবটিকস, অটোমেশন, ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, জিন প্রযুক্তি ও প্রকৌশল ইত্যাদির সমন্বয়ে আজকের বিশ্বে আমরা যে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। অনেকে এটাকে ডিজিটাল বিপ্লব হিসেবেও আখ্যায়িত করেন।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। মানুষের মেধা ও অভিজ্ঞতার বিরতিহীন প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে অর্জিত হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাংলাদেশের বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি থেকে বাঁচার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি জনমিতিক ফলাফল বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগানোর সুযোগ সৃষ্টি করছে। এদেশের যুববেকারত্বের এবং অর্ধ যুববেকারত্বের হার যথাক্রমে ১০.৯ শতাংশ ও ১৮.১৭ শতাংশ। তাছাড়া শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধমান নতুন প্রবেশকারীদের তুলনায় কর্মসংস্থান বাড়ছে না। প্রতি বছর ২.২ শতাংশ হারে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাড়ে এবং শ্রমবাজারে ২০ লাখ কর্মক্ষম নতুন মানুষ প্রবেশ করে। এর মধ্যে ১০ লাখের কর্মসংস্থান হয় আর বাকি ১০ লাখ চাকরি পায় না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা কাজে লাগাতে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি।
আমাদের যে প্রযুক্তিনির্ভরতা এসেছে সেটাতে কোনোভাবেই প্রযুক্তি দায়ী নয়। নাগরিক হিসেবে বা ভোক্তা হিসেবে আমরা নিজেরাই প্রযুক্তি নিয়ে আসছি। ডিজিটাল বিপ্লব যেন আমাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ না হয়ে মানব সভ্যতার উন্নয়ন ঘটায় এটা নিশ্চিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী যে উন্নয়ন ঘটছে সেটিকে একটা কমন প্ল্যাটফরমে আনতে হবে যাতে প্রযুক্তি কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির একক দখলে চলে না যায়। বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক ভালো করছে এবং বর্তমান বিশ্বের আধুনিক সব তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে। আগামীর প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতেও প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি খাতকে সমানভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘসহ অনেক প্রতিবেদনেই আমরা দেখি আগামীর বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের হাইটেক পার্কগুলো হবে আগামীর সিলিকন ভ্যালি। ইতিমধ্যে ৬৪টি জেলার ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদের সবকটি ডিজিটাল নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের প্রধান সেবাসমূহ বিশেষ করে ভূমি নামজারি, জন্মনিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বা চাকরিতে আবেদন ইত্যাদি ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি মৌলিক সেবাসমূহ প্রদানের বিষয়টিকে আরো সহজ ও সাশ্রয়ী করে তুলেছে। প্রযুক্তিকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মহাকাশে ভ্রমণের জন্য অত্যাধুনিক মহাকাশযান তৈরির প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, যোগাযোগ, নিরাপত্তা, গবেষণা-সব ক্ষেত্রেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুদূর প্রসারী প্রভাব থাকবে। যেমন-অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি ব্যাপক হ্রাস পাবে, উৎপাদনশিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হবে, বিশেষায়িত পেশার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। এই বিপ্লবের ফলে সব মানুষেরই আয়ের পরিমাণ বাড়ছে, সবকিছু সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে এবং মানুষ তার জীবনকে আরো বেশি মাত্রায় উপভোগ করছে। এছাড়া পণ্য বা সেবা উৎপাদন ও বিনিময় প্রক্রিয়াতেও আসছে ব্যাপক পরিবর্তন এবং এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে যাচ্ছে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। আগে যেমন বাসায় বসে সদাই করার কথা কল্পনাও করা যেত না, সামনে হয়তো বাসার বাইরে একদমই না গিয়েও সমগ্র বিশ্বের সব সুবিধা ভোগ করে জীবনযাপন করা যাবে। তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে যেমন-তথ্য চুরির আশঙ্কা, প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটা, ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তির মধ্যে অব্যাহত সংযোগ নিশ্চিতকরণ এবং অটোমেশনের কারণে বহু মানুষের কাজের সুযোগ হ্রাস পাওয়া। এসব চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানবজীবনে ব্যাপক আশীর্বাদ বয়ে আনবে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *