অর্থনৈতিক ডেস্ক: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলমান উৎপাদন ও শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয় সমসাময়িক সংস্করণ। বর্তমানে বিশ্বব্যাাপী আলোচিত নানা বিষয়ের মধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিষয়টি একটি অন্যতম অনুষজ্ঞ। এ বিপ্লব রোবটিক্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম, কম্পিউটিং ব্যায়োটেকনোলজি ইন্টারনেট অব থিংস, থ্রিডি প্রিন্টিং, সম্পূর্ণ স্বচালিত যানবাহন ও উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখন বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে। এর ভিত্তি হিসেবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দ্রব্য ও সেবা উৎপাদন, বিপণন ও ভোগের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব। বর্তমানে ব্যাকিং ও আর্থিক সেবা খাতেও প্রচলিত লেনদেন ব্যবস্থায় প্রযুক্তির হাত ধরে পরির্বতনের হাওয়া বইছে। নগদ লেনদেনের বদলে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। করোনাকালে সাবধানতা অবলম্বন করতে মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে অধিক হারে আকৃষ্ট হয়েছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের চিন্তা জগতে পণ্য উৎপাদন ও সেবা প্রদানে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি ও মানুষের জীবনধারাকে বদলে দিচ্ছে। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের সমক্ষতাকে বড়ো ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন করছে। আঠারো শতকের শেষার্ধে ইংল্যান্ডের যে শিল্প উৎপাদনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয় সেটি হচ্ছে শিল্পবিপ্লব। ১৭ শতাব্দীতে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে হস্তচালিত শিল্প ব্যবস্থাকে মেশিনচালিত পদ্ধতিতে ট্রান্সফর্মের মাধ্যমে প্রথম শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছিল। ইউরোপ ও আমেরিকায় বস্ত্র শিল্প, লৌহ শিল্প ও কৃষি শিল্পে এর প্রভাব পড়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ শিল্পেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে। এ কালে জ্বালানির উৎসগুলোতে বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস প্রভৃতি উৎপাদিত হয়। রেলপথ ও টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্ক ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। মানুষ ও তার চিন্তাভাবনার দ্রুত স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় কম্পিউটার প্রযুক্তি, সেমি কন্ডাক্টর, মাইক্রোচিপ ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক্যাল যন্ত্রপাতি ও আণবিক শক্তির উদ্ভাবন নিয়ে হয়েছিল তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। এ সময়ে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, ওষুধ শিল্প ও ব্যায়োটেকনোলজির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। ইন্টারনেট, মোবাইল যোগাযোগ এ শিল্পবিপ্লবের ফল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ইন্ডাষ্ট্রি-৪.০০ হচ্ছে আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার। দ্রব্য উৎপাদনে ও সেবা প্রদানে বিপণন ও ভোগের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। শুধু যান্ত্রিক কৌশল নয়; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উচ্চতর পর্যায়ের তথ্যপ্রযুক্তি, রোবটিক্স ও কম্পিউটারের উচ্চতর প্রযুক্তির ব্যবহার এ বিপ্লবের অন্যতম অনুষঙ্গ। এতে উৎপাদনের জন্য মানুষের যন্ত্র চালানোর পরিবর্তে যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরো নিখুত ও নির্ভূল কার্য সম্পাদন করার ক্ষেত্র তৈরি করবে। চিকিৎসায়, যোগাযোগে, উৎপাদনে, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনেও দৃশ্যমান প্রভাব অধিকতর জোরদার হবে । চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবনধারার ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। উন্নয়ন ও বাজার ব্যবস্থাপনার অবধারিত সুযোগ তৈরির আশা জাগিয়েই চলেছে।
প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মঘন্টা হ্রাস এ প্রযুক্তির সহজতর সক্ষমতা। তবে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত ঘাটতির কারণে উন্নয়নশীল দেশ ও উন্নয়নশীলের পথে উত্তরণের দেশগুলো নানা জটিলতা ও বেকারত্বের মতো সমস্যায় পড়তে পারে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় দক্ষতার ঘাটতির কারণে বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। এ সময়কালে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেশে বিদেশে চাকরিরত প্রায় ৫৭ লাখ অদক্ষ শ্রমিক এই প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থতায় বেকার হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে কোভিড-১৯ এর সময়কালেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী গতি লক্ষ করা গেলেও বিশ্ব প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলাতে ও বেকারত্ব হ্রাস, বৈষম্য ও দুনীতি দূর করতে এবং ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা আনয়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
মানুষের দৈনন্দিন পথ চলায় ব্যাংক ও আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময়কালে এ খাতের প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নে গ্রাহকদের প্রযুক্তির সঙ্গে সুপরিচিত করাও একটি চ্যালেঞ্জ। উন্নত ব্যাকিং সেবা ও ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য শিক্ষিত ও জনশক্তি তৈরি করাও চ্যালেঞ্জ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রসার লাভ করলে শ্রমশক্তির চাহিদা যে হ্রাস পাবে; শুধু তা নয়; বরং অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য বর্তমানে বিদ্যমান পেশাগুলোতে চাহিদা দ্রুত কমে আসবে। অন্য দিকে উচ্চ শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন এমন পেশায় চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। তাই দ্রুত ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের প্রযুক্তি বৈষম্য দূর করতে হবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। ফলে মানুষের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হবে, অসমতা বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে ও প্রযুক্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে। এ জন্য আমাদের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে তথ্যপ্রযুক্তির আদলে তৈরি করতে হবে।