অধ্যক্ষ মো. নিয়ামুল কবির: গিবত বা চোগলখোরি (ঝষধহফবৎরহম) একটি সামাজিক ব্যাধি । গিবত আরবি শব্দ । এর বাংলা অর্থ পরনিন্দা, পরচর্চা করা, দুর্নাম রটানো ইত্যাদি। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষের কথা বলার নাম গিবত বা পরনিন্দা। যে পরনিন্দা করে তাকে পরনিন্দুক বলে। পরনিন্দুক মহাপাপী। সে সমাজে শান্তি নষ্ট করে। আল্লাহ্ তাকে ঘৃণা করেন, ভালোবাসেন না। মহানবি (সা.) বলেন, পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তাই পরনিন্দা না করা সুন্দর চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ।
সম্মুখে রেখে কারো দোষ-ত্রুটি নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করা অথবা তার অনুপস্থিতিতে আড়ালে প্রশংসা করা সুন্নত। অথচ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আমরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই এ আদর্শ উল্টিয়ে দিয়ে গিবত বা পরচর্চা করে অনাকাক্সিক্ষত ফললাভের আশা করি, যা সম্পূণরূপে হারাম। আল্লাহ্ সুবহানু তায়ালা গিবতকারীকে মৃত ব্যক্তির গোশত ভক্ষণের ন্যায় গুনাগার হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন- “হে ইমানদারগণ! তোমরা অনেক অনুমান থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয়ই কোনো কোনো অনুমান পাপজনক হয়ে থাকে। আর তোমরা কারো দোষ অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গিবত করো না।” (সূরা হুজুরাত ৪৯: আয়াত ১২)
পরনিন্দার কারণে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। সমাজে শত্রুতা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা লোপ পায়, শান্তি নষ্ট হয়। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, “বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন: তোমরা কি জানো, গিবত কী? তারা বললেন, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি বললেন- গিবত হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। প্রশ্ন করা হলো: আমি যা বলেছি যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থেকে থাকে তাহলে আপনি কি বলেন? তিনি বললেন- তুমি তার সম্পর্কে যা বলেছ তার মধ্যে থেকে থাকে, তাহলেই তুমি তার গিবত করলে। আর যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তো তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৫৮৯)
গিবত সম্পর্কে ইন্জিল শরীফে বর্ণিত হয়েছে- যাহার ইমানের জোর কম তাহাকে আপন করিয়া লও। তাহার মতামত লইয়া তাহার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করিও না। কেহ মনে করে, সে সমস্ত কিছুই খাইতে পারে, কিন্তু যাহার ইমানের জোর কম সে কেবল শাক-সবজীই খায়। এই দুজনের মধ্যে প্রথমজন যেন দ্বিতীয় জনকে তুচ্ছ না করে এবং দ্বিতীয়জন যেন প্রথম জনের দোষ না ধরে, কারণ খোদাতো সেই দুইজনকেই আপন করিয়া লইয়াছেন। তুমি কে, যে অন্য জনের চাকরের বিচার করো? সে দাঁড়াইয়া আছে, না পড়িয়া গিয়াছে, তাহা তাহার মনিবই বুঝিবেন। কিন্তু সে দাঁড়াইয়াই থাকিবে, কারণ প্রভুই তাহাকে দাঁড় করাইয়া রাখিতে পারেন।” (ষষ্ঠ খণ্ড: রোমীয় ১৪:২, ৩, ৪)
শ্রীমদ্ ভগবত গীতায় বর্ণিত হয়েছে- “দূরেণ হ্যবরং কর্ম বুদ্ধিযোগাদ্ ধনঞ্জয়, বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণা: ফলহেতব:।। অর্থাৎ- হে ধনঞ্জয়, সকাম কর্ম নিষ্কাম কর্ম অপেক্ষা অত্যন্ত নিকৃষ্ট। সুতরাং তুমি কামনাশূন্য হয়ে বুদ্ধিযোগে নিষ্কাম কর্মের আশ্রয় গ্রহণ করো। যারা ফলাকাক্সক্ষী হয়ে কাজ করে তারা নিকৃষ্ট। (শ্লোক: ৪৯, দ্বিতীয় অধ্যায়, গীতার্থ সূত্র, পৃষ্ঠা ৬৯ )
কর্ম দুই প্রকার। যথা- সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্ম ।
সকাম কর্ম ফল লাভের আশায় করা হয়। এর বৈশিষ্ট্য: ১. আমার কর্ম আমি করি , ২.ব্যক্তি মনে করে কর্মটি আমার, ৩.কর্মফলের ভাগীও আমি।
নিষ্কাম কর্ম ফল লাভের আশায় নয়। এর বৈশিষ্ট্য: ১. কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ, ২. ফলের আকাক্সক্ষা ত্যাগ, ৩. কর্তৃত্বভাব পরিত্যাগ।
মনীষীদের উদ্ধৃতি:
১. প্রকৃতিগত প্রবৃত্তির ভালোমন্দ গ্রহণ বা বর্জনের স্বাধীনতা যদি মানুষকে দেওয়া না হতো তবে পারলৌকিক জীবনের জবাবদিহিতার প্রশ্ন উঠত না। মানুষ ভালোমন্দ বিচার বিশ্লেষণ করে পার্থিব জীবন ভোগ করবে, এটাই প্রকৃতির দাবি। কেননা পার্থিব জীবনের অমর আত্মার পারলৌকিক জীবনের সুখ-দুঃখের বোঝা বহন করবে।
- মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)
২. জাগতিক বিদ্যা (এলমে কিতাব) শিক্ষা করে নফসকে কখনো পরিশুদ্ধ করা যায় না। কারণ নফস সূতিসূ জগতের বস্তু বিধায় তাকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিশোধনের জন্য মোর্শেদে কামেলের তাওয়াজ্জোহ্ শক্তির প্রয়োজন হয়। - মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.)
৩. আপনি আপনার খারাপ চরিত্রটা পরিবর্তন না করলে আপনি নামে আশেকে রাসুল, কিন্তু কর্মে আশেকে রাসুল নন। কর্মে আপনি খারাপ মানুষ। যে কারণে মোর্শেদের কদমে এসে নিজের চরিত্রটার পরিবর্তন করতে হয়। মোরাকাবায় বসতে হয়, মোর্শেদের থেকে ফায়েজ নিতে হয়। ফায়েজ শব্দের অর্থ প্রেমের প্রবাহ। রাবার দিয়ে পেন্সিলের লেখা ঘষলে যেমন কালি উঠে যায়, তেমনি এই প্রেমের প্রবাহ নিজের অন্তরে পড়লে মুরিদের অন্তরের কলুষতা উঠতে থাকে। - ইমাম ড. আরসাম কুদরত এ খোদা (মা. আ.)
৪. নিন্দা সেই করে যার অর্জন করার মতো যোগ্যতা নেই। – ইস্ট লাউইন
সঠিক শিক্ষার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষাগুরু। এরকম গুরুর মুরিদ বা শিষ্যগণ নীতিবান না হয়ে পারেন না । এদের মাঝেই মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি, গুরুভক্তি, মহামানব ভক্তি পরিশেষে মহান প্রভুর ভক্তি লক্ষণীয়। নচেৎ নীতি দুর্বল তো শিক্ষা দুর্বল। ফলে গিবত, চোখলখোরি, গুজব ও অবৈধ ফতোয়া ইত্যাদির চর্চা দ্রæত বাড়তে থাকে। ঘূণে পোকা যেমন ধীরে ধীরে কাঠ খেয়ে অন্তঃসারশূণ্য করে ফেলে, তেমনি চোগলখোরি মানুষের নেক আমলগুলো গ্রাস করে পুরোপুরি তাকে ইমানহারা করে ফেলে। এটা বর্তমানে ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এজন্য ফেতনা-ফ্যাসাদ বা সামাজিক বিশৃঙ্খলাও বেড়ে গেছে। কিন্তু কখনো কখনো কোনো ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি, দেশ কিংবা জাতিকে বাঁচাতে গিবত বা কঠোর সমালোচনা করা জরুরি হয়ে পড়ে। যেমন- কোনো ব্যক্তি মানুষের ইমান ধ্বংস করার প্রোপাগান্ডা চালালে বা গুজব ছড়ালে, জাতিকে সচেতন করতে তাদের নোংরা কাজগুলো মানুষকে জানিয়ে দেওয়া জরুরত।
উপযুক্ত তাসাউফ বিজ্ঞানীর নিকট হতে নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে, আমাদের সকলের ব্রত হোক, গুজব ছড়াবো না। হে আল্লাহ! আমাদের সকলকে হিদায়েত নসিব করুন। আমিন ।