দুলাল আল মনসুর: রহস্যময় আর আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যে অনন্য সৌন্দর্যে ভরা দেশ নরওয়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে বলা যায়, পৃথিবীর বুকে একখণ্ড স্বর্গ। দক্ষিণ কিংবা পূর্ব দিকের সৌন্দর্যের চেয়েও যেন দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমের মোহময় রূপ হাতছানি দিয়ে ডাকে পৃথিবীর সৌন্দর্য পিপাসুদের। ইয়ন ফসসের কথা বলতে গিয়ে এসব প্রসঙ্গ আসা খুব স্বাভাবিক।
এ রকম দেশের নির্জন এলাকায় বেড়ে ওঠা নাট্যকার, কবি, কথাসাহিত্যিক ইয়ন ফসসে এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর বেড়ে ওঠার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে তৈরি হয়েছে তাঁর লেখালেখির বিষয়বস্তু ও শৈলী। ষাট পেরোনো ইয়ন ফসসের এখনো মনে আছে তাঁর প্রথম লেখার অভিজ্ঞতার কথা। ১২ কিংবা ১৩ বছর বয়সে গান লিখেছিলেন।
সেই সময়ই কয়েকটা কবিতা ও গল্পও লিখেছিলেন তিনি। তখনই বুঝেছিলেন, নির্জন জায়গায় বসে নিজের জন্য লেখার মধ্য দিয়ে নিজের জন্য একদম গোপনীয় একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়। এ রকম জায়গায় থাকতে তাঁর ভালো লেগেছিল। পরিণত বয়সেও বুঝতে পারেন ওই জায়গাটা সরাসরি তিনি নিজে নন; তবে তাঁর ভেতরে আছে ওই রকম জায়গা।
ব্যক্তি ফসসের থেকে আলাদা একটা অস্তিত্ব আছে ওই জায়গাটার। তিনি মনে করেন, ব্যক্তি ইয়ন ফসসে নামে একজন মানুষ আছেন। কিন্তু লেখক হিসেবে তাঁর কোনো নাম-পরিচয় নেই। মানে, লেখার ভেতরে তিনি নেই।
নিজের ভেতর তৈরি করা ওই জায়গাটা চলাচলের একটা জায়গা; এখান থেকে অনেক কিছু শোনা যায়।
আর থেকে যাওয়ার জন্য একটা নিরাপদ জায়গা এটা। আবার এখানে থাকাটা একটু ভয়েরও বটে। কারণ অজানা-অচেনা জগতে প্রবেশ করার রাস্তাও এই জায়গাটা। তিনি একসময় বুঝতে পারেন, তাঁর নিজের মনের সীমান্তে যেতে চান। সীমান্ত পার হয়ে যাওয়ার তাড়নাও বোধ করেন।
বিশাল সমুদ্র, উঁচু পর্বত, স্বচ্ছ ঝরনা যেমন তৈরি করেছে তাঁর মনের ভেতরের নতুন জগৎ, তেমনি তাঁর লেখক সত্তার ওপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে তাঁর দেশের অতল ফিওর্ড। তাঁর লেখার আবহ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে ছেলেবেলার ফিওর্ডের বুকে নৌকায় ভেসে বেড়ানোর স্মৃতি। মাত্র সাত-আট বছর বয়সেও তিনি একা নৌকায় ফিওর্ডের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা পেয়েছেন। সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে এবং কখনো কখনো বাবার সঙ্গে নৌকায় চড়েছেন। গ্রীষ্মের সময় কিংবা শরতের শুরুতে বিকেলে এবং সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যেতেন ফিওর্ডে। তীরে কিংবা স্থলভাগে অন্ধকার নেমে আসা সন্ধ্যার ভেতর তিনি যতটা দৃশ্যমান ছবি দেখেছেন; তার চেয়েও বেশি অনুভব করেছেন রং আর শব্দ। পরবর্তী সময়ে লেখার সময়ও তাঁর এই অভিজ্ঞতাটা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে: লেখার সময় আক্ষরিকভাবে কিংবা স্বচ্ছভাবে কিছু দেখেন না, কল্পনাও করেন না তিনি। লেখার সময় তিনি শ্রবণের প্রক্রিয়ায় থাকেন। লেখার কাজ তাঁর কাছে শ্রাবণের কাজ। কিছু একটার শব্দ বাজতে থাকে তাঁর কানে। তবে কোথা থেকে আসে এই শব্দ, তিনি শুনতে পান না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ফসসের লেখার একটা শক্তিশালী দিক হলো তাঁর সাংগীতিক বোধ। ছেলেবেলায় তিনি একটা ব্যান্ডে গিটার বাজাতেন। পরিণত বয়সেও তিনি বিশ্বাস করেন, লেখার সঙ্গে সুরের একটা সম্পর্ক রয়েছে। রক থেকে গীতিকা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গিটারের সুর ঠিক করা থেকে টাইপরাইটারের শব্দ এবং শেষে কম্পিউটারের কি-বোর্ডের শব্দের মধ্যে তিনি সুর তৈরি করেছেন।
শব্দ আর নিঃসঙ্গতা তাঁর লেখক সত্তা এবং লেখার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। নিঃসঙ্গ অবস্থায় লেখালেখি করার মধ্যে ফসসে খানিকটা রহস্যময়তার সন্ধান পান। অন্য লোকদের সান্নিধ্যে তিনি যতটা আধ্যাত্মিক বোধ অনুভব করেন, তার চেয়ে বেশি বোধ করেন নিজের সান্নিধ্যে অর্থাৎ লেখালেখির সময়। একা একা লেখার সময় তাঁর মধ্যে এক ধরনের ধর্মীয়বোধ তৈরি হয়। সেই বোধটাকে তিনি রহস্যময় বলেই মনে করেন। মনে করেন, লেখালেখির সঙ্গে এটা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। জীবন থেকে অন্যান্য অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে নিজেকে ইতিবাচক পরিবর্তন করতে যতটুকু পেরেছেন, তার চেয়ে বেশি পরিবর্তন তাঁর ওপর এসেছে তাঁর লেখার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তাঁর মনের ভেতর একসময় অনমনীয় নিশ্চয়তা ছিল। লেখার মাধ্যমে সেটা পরিবর্তিত হয়েছে এবং নিজের আরেকটা সত্তার কাছে তিনি সহজেই পৌঁছে যেতে পেরেছেন। নিজের অন্য সত্তাকে তিনি তাঁর ‘আমি’ সত্তার চেয়ে মহত্ত্বর বলেই মনে করেন। এজন্যই তাঁর লেখার একটা বিরাট অংশজুড়ে আছে এই দ্বৈত সত্তার মিথস্ক্রিয়া।
কথাসাহিত্যে লেখকের ব্যক্তিগত পরিচয়কে আলাদা সত্তা বলেই মনে করেন ফসসে। উদাহরণ হিসেবে ইয়ন ফসসের ‘বোটহাউস’ উপন্যাসের কথা বলা যায়। এ উপন্যাসের শুরুতে বলা হয়, ‘আমি আর বাইরে যাই না। আমার ওপর ভর করেছে এক রকম অস্থিরতা এবং আমি বাইরে যাই না।’ ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকের আর কোনো উপন্যাসের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় না এভাবে হাজির করা উপন্যাসের সঙ্গে। তবে ফসসে নিজে এ উপন্যাস লেখার আগে এবং পরে এ রকম লেখা আরো লিখেছেন। উপন্যাসের শুরুতে ফসসের উপস্থিতি পাঠকের কাছে স্পষ্ট মনে হলেও এই উপস্থিতি ফসসের ব্যক্তিগত উপস্থিতি নয়। এই উপন্যাস লেখার সময় ব্যক্তি ফসসে কেমন ছিলেন সেটা জানা না জানার মধ্যে পার্থক্য খুব কম এবং ওই সময়ের ফসসেকে চিনে থাকলেও এই চেনাটা তাঁর উপন্যাস পড়ার ক্ষেত্রে সরাসরি সহায়ক হওয়ার কথা নয়। একই কথা প্রযোজ্য যে সমাজে, যে সময়ে এই উপন্যাস লেখা হয়েছে সে সম্পর্কে জানাশোনার বিষয়েও। তার মানে, ব্যক্তির নিজস্বতা নতুন এবং অপরিচিত সৃজন প্রবাহে বিলীন হয়ে যায় কল্পিত অবয়বের মাঝে।
ইয়ন ফসসের প্রবন্ধ প্রধানত সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ক। তবে শিল্প-সাহিত্যের জীবনীমূলক কিংবা সমাজতাত্ত্বিক কিংবা ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আগ্রহী নয় তাঁর প্রবন্ধগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি। অবশ্য যেসব বিষয় সাহিত্যকে সাহিত্য হয়ে উঠতে এবং শিল্পকে শিল্প হয়ে উঠতে সহায়তা করে থাকে সেসব বিষয় আলোচনার কেন্দ্রেই রাখা হয়েছে তাঁর প্রবন্ধে। যেসব বিষয় অপরিহার্য, রূপান্তর-অযোগ্য এবং অনেকটা দুর্জ্ঞেয়, সেগুলো নিয়ে কথা বলা হয়েছে তাঁর প্রবন্ধে। ফসসের গদ্য লেখার মধ্যে প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্য-উভয়ই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য: তাঁর প্রবন্ধ বাইরে থাকা মানুষের মতো শিল্পের কুয়ার মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখে, শিল্পের ভেতরের দিকে দৃষ্টি ফেলে এবং তদন্ত করে দেখার মতো অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকায়। শিল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে কৌতূহলবোধ করে-আপনার, আমার, আমাদের সঙ্গে শিল্প কিভাবে প্রাসঙ্গিক সে ধরনটা দেখে এবং এভাবেই সমাজের সঙ্গে শিল্পকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে। তাঁর ১৯৮০-র দশকের প্রবন্ধ আশির দশকের মতো, নব্বইয়ের দশকের প্রবন্ধ নব্বইয়ের দশকের মতোই। কিন্তু তাঁর কথাসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য একেবারেই আলাদা: বাইরে থেকে ভেতরের দিকে তাকানোর পরিবর্তে ভেতর থেকে বাইরের দিকে দৃষ্টি ফেলে তাঁর কথাসাহিত্য। তার মানে, বাইরের জগতের দিকে দৃষ্টি ফেলে এবং পাঠকের দিকেও তাকায়। ফসসের প্রবন্ধের ভেতরের কণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে সমসাময়িক কালে। কিন্তু তাঁর কথাসাহিত্যের কণ্ঠ তাঁর সময়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। তাঁর কথাসাহিত্যের কণ্ঠ বরং অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাঁর প্রবন্ধ এই অন্যকিছুকে বিভিন্ন উপায়ে আলাদা করে দেখার চেষ্টা করে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট প্রবন্ধ লেখার সময় অনুসারে দেখার চেষ্টা করে।
কল্পনার সঙ্গে একাধিক ইন্দ্রিয় দিয়ে মনের ভেতরের আবহ তৈরি করেন ইয়ন ফসসে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ভেতরের অসীমতা এবং বাইরের সীমাবদ্ধতার মাঝে বিরাজিত যে পার্থক্য, সেই পার্থক্যই ইয়ন ফসসের সব লেখার চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।