বাণিজ্য ডেস্ক
ক্লডিয়া গোলডিন
তৃতীয় নারী হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে নোবেল কমিটি।
এর আগে যে দুই নারী অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন এলিনর অস্ট্রম ও এস্পর দুফলো।
ক্লডিয়া গোলডিনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের পরিণতিতে কী ঘটছে, সে বিষয়ে আমাদের বোঝাপড়া উন্নত করেছেন তিনি। ২০০ বছর সময়ে নারীর শ্রমশক্তিকে অংশগ্রহণ ও তাঁদের আয় নিয়ে গবেষণা করেছেন গোলডিন। মূলত, যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ নিয়ে তিনি এ গবেষণা করেন। বলা হয়েছে, এ বিষয়ের প্রথম পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকেছেন তিনি। দেখিয়েছেন, নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যবধান সব সময়ই ছিল; যদিও একেককালে তা ছিল একেক রকম। এই যে নারী-পুরুষের ব্যবধান এবং তার রূপের পরিবর্তন, ক্লডিয়া গোলডিনের গবেষণায় তার কারণ উন্মোচিত হয়েছে। একধরনের মডেল দিয়েছেন তিনি।
নোবেল প্রাইজ ডট অর্গে বলা হয়েছে, অনেক উচ্চ আয়ের দেশে গত এক শতকে বেতন-মজুরিভিত্তিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ তিন গুণ হয়েছে। আধুনিক সময়ের ইতিহাসে এটি অন্যতম বৃহৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, ‘ তা সত্ত্বেও নারী-পুরুষের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান রয়ে গেছে। গত শতকের আশির দশকে ক্লডিয়া গোলডিন এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা শুরু করেন।
আজ বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টা ৪৫ মিনিটে দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস এই নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করে। অনুষ্ঠানে ক্লডিয়া গোলডিনের সরাসরি যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও প্রযুক্তিগত জটিলতার কারণে তিনি শেষমেশ যুক্ত হতে পারেননি।
ক্লডিয়া গোলডিনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মূল বিষয় হচ্ছে, আগে এবং এখনো নারীর সিদ্ধান্ত মূলত তাঁর বিয়ে ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের নিরিখে নির্ধারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মূলত, যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করলেও তাঁর অন্তর্দৃষ্টি কাল-সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে যায়।
তবে ক্লডিয়া গোলডিনের কাজ খুব সহজ ছিল না। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, একসময় সরকারি পরিসংখ্যানে শুধু পুরুষের কাজের তথ্য-উপাত্ত থাকত, নারীদের থাকত না। ফলে অভিলেখাগার বা আর্কাইভে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে; রীতিমতো তথ্য গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। অভিলেখাগারের বিপুল তথ্যভান্ডার ঘেঁটে তাঁকে বের করতে হয়েছে, নারীর ভূমিকা কী ছিল।
সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। কিন‘ ক্লডিয়া গোলডিন ২০০ বছরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণায় দেখেছেন, এই সময়ে শ্রমশক্তিতে নারী অংশগ্রহণ শুধু বেড়েছে—বিষয়টি মোটেও তেমন নয়, বরং এ-বিষয়ক রেখাচিত্র ইংরেজি ইউ আকৃতির। অর্থাৎ এই ইতিহাস সরলরৈখিক নয়। দেখা গেছে, কৃষিসমাজ থেকে শিল্পসমাজে উত্তরণের সময় উনিশ শতকে বিবাহিত নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমেছে। এরপর বিশ শতকের শুরু থেকে সেবা খাতের বাড়বাড়ন্ত হতে শুরু করলে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।
ক্লডিয়া গোলডিনের ব্যাখ্যা হলো, মূলত কাঠামোগত পরিবর্তন এবং পরিবার ও সমাজে নারীর দায়িত্ব-কর্তব্যবিষয়ক সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়েছে। বিশ শতকে নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। অধিকাংশ উচ্চ আয়ের দেশে নারীর শিক্ষার মান পুরুষের চেয়ে বেশি।
আরেকটি কারণে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এসেছে। সেটা হলো, জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী। এটা নারীকে ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা করার সুযোগ দিয়েছে, অর্থাৎ স্বাধীনতা দিয়েছে।
তবে এত পরিবর্তন সত্ত্বেও কিছু পুরোনো বিষয় এখনো রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ক্লডিয়া গোলডিন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নারী-পুরুষের আয়ের ব্যবধান তেমন একটা কমছে না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করেন, এর আংশিক কারণ হচ্ছে শিক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত সাধারণত কম বয়সে নেওয়া হয়। তর“ণীদের আকাঙ্ক্ষা যদি আগের প্রজন্মের নারীদের অভিজ্ঞতার আলোকে নেওয়া হয়, অর্থাৎ মেয়েরা যদি মাকে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়—যে মা হয়তো সন্তান বড় হওয়ার আগে কাজে ফেরত যাননি—তাহলে উন্নয়নের গতি কমে যায়।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, নারী-পুরুষের আয়ের বৈষম্যের পেছনে শিক্ষা ও পেশার ভূমিকাই মুখ্য। গোলডিন দেখাচ্ছেন, আগের সেই জামানা আর নেই। এখন দেখা যায়, একই পেশায় নারী ও পুরুষের মধ্যে বেতনের পার্থক্য তৈরি হচ্ছে; যে ব্যবধানের সূত্রপাত হয় নারীর প্রথম সন্তান জন্মলাভের পর।
দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের কমিটি ফর দ্য প্রাইজ ইন ইকোনমিক সায়েন্সেসের চেয়ারম্যান জেকব স্ভেনসন বলেছেন, ‘শ্রমশক্তিতে নারীর ভূমিকা বোঝা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ক্লডিয়া গোলডিনের এই উদ্ভাবনী কাজের সূত্রে আমরা এখন এই বিষয়ের অন্তর্নিহিত কারণ সম্পর্কে জানতে পারছি।’
উল্লেখ্য, অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ১৯৬৯ সাল থেকে। সেই বছর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫৫ বার এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।