অকার্যকর হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক

অকার্যকর হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: যশোরের রাজিউর রহমান (৫২) সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বছরখানেক আগে। হাঁটুর নিচের অংশ ভেঙে ও থেঁতলে যাওয়ায় তার অপারেশন করেন চিকিৎসক। কিছুদিন পর ওই জায়গায় ইনফেকশন হলে বাধে বিপত্তি। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করেনি তার শরীরে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. তুষার মাহমুদ বলেন, ‘এ রোগীর পায়ে ইনফেকশন হলে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিই। কিন্তু দেখা যায়, অ্যান্টিবায়োটিক তার শরীরে কাজ করছে না। ২০টি অ্যান্টিবায়োটিকের টেস্ট দিলে দেখা যায়, রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর বা রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে। তারপর আরও ২০টি টেস্ট দিলে দেখা যায় সেগুলোও অকার্যকর তার শরীরে। এরপর সব অ্যান্টিবায়োটিক টেস্ট দিয়ে দেখা যায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই তার শরীরে কাজ করছে না। শুধু এই একজন রোগী নন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স রোগী এখন নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোগীদের এই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।’
কিছু কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ৮২-৮৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। গড়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের হার ৫০ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের হার বেড়েছে ১১ শতাংশ। জাতীয় ওষুধ প্রতিরোধী জরিপের ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানা যায়। গতকাল রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকির হোসেন হাবিব। ২০১৭-২০২৩ পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনে তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণু বাংলাদেশে ভয়াবহ হারে বাড়ছে। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রোগীদের ক্ষেত্রে লিনেজোলিড জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের হার ৭০ শতাংশ; যা বহির্বিভাগে প্রতিরোধের হার ৮২ শতাংশ। এখানে কার্বপেনমের মতো ওষুধের প্রতিরোধী হার ৮৪ শতাংশ। ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রস্রাবে ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া যায় ৭০ শতাংশ। তবে রক্তে এ হার কিছুটা কম, ১০ শতাংশ। ইনডোর, আউটডোর, আইসিইউতে এমিক্যাসিন, ফসফোমাইসিন এবং কার্বপেনমের প্রতিরোধী হার দেখা গেছে ৯০ শতাংশ। যেখানে নিউট্রোফুরানশন প্রতিরোধের হার ৭২ শতাংশ। এমনকি তৃতীয় প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে পরিচিত সিফ্রোক্সোজনের প্রতিরোধী হার ৪৭ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ওষুধ-প্রতিরোধী জীবাণু সাধারণ জীবনযাত্রার জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই এ ক্ষেত্রে আরও গবেষণা বাড়াতে হবে। গবেষণা ছাড়া আমরা কিছুই জানতে পারব না এবং প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, ‘সার্জারির ক্ষেত্রে আমরা এ ধরনের জটিলতা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করি। সেফলসপ্রিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণু-প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে আরও দেখা যায়, বেশির ভাগ রোগী যক্ষ্মায় আক্রান্ত। তাদের অধিকাংশ একাধিক ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত। শিগগিরই নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আসার তথ্য আমাদের জানা নেই। তাই এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে মানুষের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে।’ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন। বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটু মিয়া, স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির। এ সময় জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিজের অভিজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন গত বছর আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। চার মাস জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আগস্টে এসে জানা যায় আমার শরীরে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। তখন মনে হচ্ছিল তাহলে কি অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করায় আমি আর বাঁচতে পারব না! ওই সময়টা আমার চোখের সামনে ভাসছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জেলা হাসপাতালগুলোয় ব্লাড কালচার হয় না। এ কারণে রোগীদের যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করানো হয়। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলা লক্ষ্য করা যায়। রোগীর ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক না দিলে যেন তাদের চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে মেরপেনোমের মতো অ্যান্টিাবায়োটিক উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর আগ্রাসি বিপণন তো রয়েছেই।’ এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বক্তারা ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করলে ওষুধ আইনে ২০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বড় উদ্বেগের কারণ হলেও আগের আইনে তা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিধিবিধান ছিল না। জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেটে লাল রঙের মার্কিংয়ের নির্দেশনা দেওয়ার নিয়ম হয়েছে। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *